অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
আবাসন খাতে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা বাতিল এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে আগামী ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরে জাতীয় বাজেট পাস করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। বাজেটে কয়েকটি খাতে কর হ্রাস এবং সরকারি চাকুরেদের সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে সকালে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন কাজ শুরু হবে। সংসদ না থাকায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট কার্যকর করা হবে।
২২ জুন বিকেলে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্স রুমে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এবারকার বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন। কারণ সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে গেছে বা দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। এ দুর্বল প্রতিষ্ঠান দিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমরা আর ঋণ করে ঘি বা পোলাও খেতে চাই না। তাই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে বাজেট ছোট করে বাস্তবসম্মত করা হয়েছে। এরপরও বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশ এবং ঘাটতি ধরা হয়েছে তিন দশমিক ২ শতাংশ, যা যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে কম। তিনি জানান, বাজেটে আবাসন খাতে কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ ছিল তা বাতিল বা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টাকে সহায়তা করেন অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়রুজ্জামান মজুমদার এবং এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান।
এবারের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করাই বড় পরিবর্তন। ২ জুন প্রস্তাবিত বাজেটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট এবং ভবন কেনায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়। তবে আগের চেয়ে করের পরিমাণ ৫ গুণ বাড়ানো হয়েছিল। বলা হয়, এলাকাভেদে আয়তন অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলেই টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে বলে ধরে নেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, পৌর এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে এক শ’ থেকে দুই হাজার টাকা কর হারের প্রস্তাব ছিল। এ ছাড়া একই সুবিধা পেতে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে ৫০ থেকে ৯০০ টাকা কর নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এখন এসব সুযোগ বাতিল হলো।
এ দিকে বাজেটে শেয়ার বাজারে রয়েছে এমন কোম্পানি যাদের পরিশোধিত মূলধনের অন্যূন ১০% শেয়ার আইপিও বা ডিরেক্ট প্লেসিং-এর মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে উক্ত আয়ের ২২.৫% করারোপ করা হয়েছে। তবে বিবেচ্য আয়বর্ষে সর্বপ্রকার আয় ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করলে উক্ত করহার ২০% করা হয়েছে। অন্যান্য সব পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৭.৫% করারোপ করা হয়েছে। তবে বিবেচ্য আয়বর্ষে সর্বপ্রকার আয় ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করলে উক্ত করহার ২৫% করা হয়েছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজের করহার ১৫%-এর স্থলে ১০% করা হয়েছে; সম্পত্তি হস্তান্তর হতে কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর কর্তনের হার ৮%, ৬% ও ৪%-এর স্থলে যথাক্রমে ৫%, ৩% ও ২% করা হয়েছে।
মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট)-এর ক্ষেত্রে পরিবর্তন : রিফাইন্ড পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর ৭.৫ শতাংশের পরিবর্তে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। ঝুট হতে রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তুলার উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তা কর্তৃক পরিচালিত বিউটি পার্লারের স্থান ও স্থাপনার ভাড়ার ওপর মূসক অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
পয়েন্ট বলপেনের আমদানি পর্যায়ে মূসক অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। হার্টের রিং ও চোখের লেন্স আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
শুল্ক হ্রাস যেসব খাতে- সব ধরনের পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে ইনভয়েস মূল্যের ভিত্তিতে শুল্কায়ন ব্যবস্থা চালুর উদ্দেশ্যে বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ক্রুড পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ৫% আমদানি শুল্ককে কমিয়ে ৩% এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নির্ধারিত ১০% আমদানি শুল্ককে কমিয়ে ৬% নির্ধারণ করা হয়েছে।
সৌর শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিকে আরো সহজলভ্য করার উদ্দেশ্যে সোলার ইনভার্টারের আমদানি শুল্ক ১০% হতে হ্রাস করে ১% নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটে জারিকৃত হাসপাতাল কর্তৃক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ও উপকরণ রেয়াতি সুবিধায় আমদানিসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে আরো ১০টি আইটেম যুক্ত করা হয়েছে, ফলে জনগণের জন্য চিকিৎসাসেবা আরো সহজলভ্য করা যাবে।
দেশে মানসম্পন্ন টায়ার উৎপাদনের জন্য টায়ার তৈরির অন্যতম কাঁচামাল টেকনেকেলি স্পেসিফাইড রাবারের আমদানি শুল্ক ১০% হতে কমিয়ে ৫% নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ দিকে ইতঃপূর্বে উপস্থাপিত বাজেটের ওপর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মতামত এবং অর্থ বিভাগের ওয়েবসাইটে নাগরিকদের নিকট থেকে প্রাপ্ত মতামতের ওপর ভিত্তি করে নিম্নরূপ পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়।
এ পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে সুপারিশকৃত ৮১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকার পরিবর্তে ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে, যা ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাজেটে ছিল ৯০ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। অবসরভাতা ও সঞ্চয়পত্রের সুদ এতে অন্তর্ভুক্ত নেই।
ইতঃপূর্বে ঘোষিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা চাকরিরতদের জন্য ন্যূনতম এক হাজার ৫০০ টাকা এবং পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭ ৫০ টাকা করা হয়েছে। নিট পেনশন ১৭ হাজার ৩৮৮ টাকার ঊর্ধ্বে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ১০% এবং তদনিম্নের ক্ষেত্রে ১৫% হারে বিশেষ সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি সশস্ত্রবাহিনী, বিচারপতি এবং এমপিওভুক্তদের ক্ষেত্রে পৃথক আদেশ করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। এ ছাড়াও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরবর্তী সময়ে রফতানি-নির্ভর প্রণোদনা ধীরে ধীরে প্রত্যাহারের ৩য় ধাপ হিসেবে হ্রাসের কার্যক্রম ১ জুলাই ২০২৫-এর পরিবর্তে ১ জানুয়ারি ২০২৬ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে বাজেটে। ●
অকা/আখা/ফর/রাত/২৩ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 weeks আগে