তারেক আবেদীন ●
দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড গভীর সংকটে পড়েছে। বীমা ব্যবসায়ে কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য ব্যাংক লেনদেন কার্যক্রম স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে ২০ অক্টোবর থেকে। কোম্পানির হিসাব স্থিত (ফ্রিজ) করে দেশের তফশিলি বাণিজ্যিক ব্যাংক পুবালী ব্যাংক পিএলসি ও যমুনা ব্যাংক পিএলসি থেকে এদিন জানিয়ে দিয়েছে বলে বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়। আর তা করা হয়েছে সরকারি নির্দেশে। ৮ অক্টোবর ১৬ বছরে অর্থাৎ ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছর থেকে ২০২২-২০২৩ অর্থ বছর অবধি হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর ই-টি.এন.আই-১৯৮২৫৩৯২৪৩১৯ ’র বিপরীতে সরকারের আয়কর বাবদ মোট পাওনা ৮১ কোটি ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৯১০ টাকা চলতি বছরের ১৭ অক্টোবরের মধ্যে পরিশোধ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ২৮ বছরের কোম্পানিটি সে নির্দেশ আমলেই নেয়নি। হোমল্যান্ড লাইফের দীর্ঘদিনের বকেয়া আয়কর পরিশোধ প্রসঙ্গে কর কমিশনার কার্যালয়ের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের উপ কর কমিশনার মো. আইয়ুব আলী কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর পত্র (বকেয়া/বৃকইউ/২০২৪-২৫/০১) প্রেরণ করেন। পত্রে উল্লেখ করা হয় যে, আয়কর আইন, ২০২৩ ’র ২৭৫ ধারা অনুযায়ী অনাদায়ী বকেয়া আয়কর আহরণের ক্ষেত্রে অনাধিক বকেয়ার সমপরিমাণ জরিমানার বিধান রয়েছে। হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডকে আয়কর আইন, ২০২৩ ’র ২২১ ধারা অনুসারে বকেয়া আয়কর সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে তার দালিলিক প্রমাণ সংশ্লিষ্ট কর কমিশনারের কার্যালয়কে প্রদান করা ছাড়াও কোম্পানিটিকে জরিমানাও দিতে হবে।
বীমা খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) দেশের ১০টি জীবন বীমা কোম্পানি বেশ কবছর ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এরমধ্যে হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডসহ ৯টি কোম্পানি অবস্থা শোচনীয়। বাকি কোম্পানিগুলো হলো- বায়রা, সানফ্লাওয়ার, সানলাইফ, পদ্মা, গোল্ডেন, ফারইস্ট, স্বদেশ ও সোনালী। অধিকাংশ কোম্পানিগুলোতে গ্রাহকদের ন্যায্য দাবী দিনের পর দিন আটকে আছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের বেতন ভাতা ও পাওনা বকেয়া রাখা, মালিকদের মধ্যে দলাদলি, ভূয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বৃদ্ধি, অবৈধভাবে জমি ক্রয়, মামলা-মোকদ্দমায় জড়ানো, মূলধন ভেঙ্গে খেয়ে ফেলা, তহবিল তসরূপ, অর্থ কেলেংকারি, আইন ও বিধান না মানা, ঘনঘন উর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পাল্টানো, যোগ্য ও শিক্ষিত নির্বাহীকে সরিয়ে অযোগ্য মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ, রাজনৈতিক প্রভাব প্রদর্শন ইত্যাদি কার্যক্রম উল্লেখিত কোম্পানিগুলোতে বেশ সময় ধরে বিরাজমান। এদের দুরবস্থায় বেকায়দায় আছে আইডিআরএ। গ্রাহক স্বার্থরক্ষার কথা ভেবে ব্যর্থ কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারছে না নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান।
২৮ বছরের পুরানো বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডতে উল্লেখিত সমস্যার অধিকাংশই রয়েছে। কোম্পানিটিতে নিয়মিত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নেই অনেকদিন ধরে। এক বছরে ৩ জন প্রধান নির্বাহীকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। এখন যিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক অভিযোগ। অন্য কোম্পানি থেকে ছাড়পত্র ছাড়া পর্ষদকে ব্যবসায়ের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এ ১২ সেপ্টেম্বর যোগদান করেছেন উল্লম্ফনবাজ মোহাম্মদ আবদুল মতিন। স্বল্প সময়ের মধ্যে ভূয়া শিক্ষা সনদধারী বীমা নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মতিন প্রাইম ইসলামী লাইফ থেকে বেস্ট লাইফ ও মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ হয়ে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এ এখন প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে। কোম্পানির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র অর্থকাগজকে জানায়, জীবন বীমা ব্যবসায়ে মাসে প্রথম বর্ষ ৫ কোটি ও ৫ কোটি টাকার নবায়ন প্রিমিয়াম আদায় করে দিবেন এই প্রতিশ্রুতিতে তার মাসিক বেতন বাবদ ৩ লাখ এবং অন্যান্য সুবিধা ভোগ করছেন তিনি। কিন্তু গত মাসে তিনি প্রথম বর্ষের প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে মাত্র ১ লাখ ২৪ হাজার। তার নেতৃত্বে নবায়ন আদায় হয়েছে ৪৪ লাখ টাকা। মোহাম্মদ আবদুল মতিনের অপকর্মের বিরুদ্ধে জাতীয় পত্রিকায় নেতিবাচক খবর প্রকাশ হলেও হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর মালিকেরা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মোহাম্মদ আবদুল মতিনের স্নাতকোত্তর (ব্যবসা প্রশাসন) শিক্ষা সাময়িক সনদ যাচাইয়ের লক্ষ্যে অর্থকাগজ এর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. বিজয় সনকার বড়ুয়া গত ২৭ জুন, ২০২৪ জানান, মোহাম্মদ আবদুল মতিনের ছাত্র আইডি, ডিগ্রি ও অর্জিত নম্বর সবই ভূয়া।
জানা গেছে, মনগড়া ও কাল্পনিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কোম্পানিটির বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) ২৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বীমা গ্রাহকদের মেয়াদপূর্ণ দাবীর পরিমাণ ১৫৭ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর অবধি এ বাবদ ৯ মাসে আরও যোগ হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। ১৬ বছরের বকেয়া আয়কর ও অনিষ্পন্ন দাবী মিলিয়ে হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর বর্তমান সময় পর্যন্ত দায় প্রায় ২৬৫ কোটি টাকা। হোমল্যান্ড লাইফের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন সাংগঠনিক অফিসে বকেয়া ভাড়ার জন্য পাওনাদাররা ধর্না দিচ্ছে প্রতিদিন। দীর্ঘ সময়ের পুঞ্জীভত পাওনা ও গ্রাহকের দাবী আদায়ের জন্য রাজধানীর মতিঝিলস্থ এল্লাল চেম্বারে অবস্থিত কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে গ্রাহক ও মাঠের উন্নয়ন কর্মীদের হতাশা দৃশ্যমান। এ নিয়ে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পাওনাদার বাক-বিতন্ডা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এত সমস্যার মধ্যেও পর্ষদ কক্ষে সভার নামে কোম্পানি মালিকদের বড় বড় হোটেল রেস্তোঁরা থেকে খাবার খাচ্ছেন। বন্ধুদের আপ্যায়িত করাচ্ছেন। তাদের অন্যান্য ব্যয়ও কমছে না। অভিযোগের অন্ত নেই হোমল্যান্ড লাইফের বিরুদ্ধে।
সিলেটে টুকের বাজারে জমি কেনার নামে আত্মসাৎ করা হয় ১.৫১ কোটি টাকা। অস্তিত্বহীন জমিতে বিনিয়োগ করে এ কোম্পানি। জমি কেনার জন্য অগ্রিম দেয়া হয়। অথচ সেই জমি নিবন্ধন হয়নি। ফেরত নেওয়া হয়নি জমি কেনা বাবদ অগ্রিম টাকা। কোম্পানির সার্ভিস সেন্টারে অগ্রিম কমিশন ও বেতন-ভাতা পাঠিয়ে তা আবার নগদে তুলে নেয়া হয়। হোমল্যান্ড লাইফ গ্রাহকের জমা করা টাকা থেকে লোপাট করা হয় ১০৪ কোটি টাকা। তা হয়েছে ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে। আর এ লুটপাটে জড়িত কোম্পানির স্বয়ং মালিকরাই।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিণ্ঠান বিভাগ থেকে প্রাপ্ত এক তথ্যে জানা গেছে, আইন অনুয়ায়ী ১৯৯৯ সালে হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড অতিরিক্ত মূলধন সংগ্রহের জন্য গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে দেশের পুঁজি বাজারে যাওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল। কিন্তু ২৫ বছরেও ব্যর্থ হয়েছে ১৯৯৬ সালে ২৩ মে নিবন্ধিত কোম্পানিটি। চলতি বছরের শুরুতে হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড পুঁজি বাজারের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ আবেদন করার কথা। সে ব্যাপারেও কোম্পানিটি ব্যর্থ।
আলোর আগমনে ‘লোডশেডিং’
ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আবদুল মতিন উন্নয়ন ও বিপণন কর্মী হিসেবে উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ২ লাখ টাকার মাসিক বেতন, কমিশন ও অন্যান্য সুবিধায় হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এ অনেকদিনের ‘মনবন্ধু’ লুৎফুন নাহার আলোকে নিয়ে আসেন। বাচাল, অপ্রয়োজনীয় কথক এবং অযৌক্তিক হস্তক্ষেপকারী লুৎফুন নাহার আলোর এ যোগদান হোমল্যান্ড লাইফের কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মীরা কেউ ভালো চোখে দেখছেন না। মতিন ও আলোকে নিয়ে তারা কানাঘুষা করছেন। প্রাইম, বেস্ট ও মার্কেন্টাইলে দুজনের গভীর সম্পর্কের মুখরোচক কাহিনী বীমা পাড়ায় মুখে মুখে। ব্যবসায়ে প্রায় লবডঙ্কা মোহাম্মদ আবদুল মতিন ও লুৎফুন নাহার আলো। জানা গেছে, আগের কোম্পানি মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এ দুবন্ধুর থাকা অবস্থায় এর মাঠ সংগঠন ও প্রশাসন শৃঙ্খলাহীন হয়ে পড়ে। মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফের পর্ষদ ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুঝতে পারে ব্যবসায়ে মাঠ পর্যায়ে অনিয়ম হচ্ছে, আশানুরূপ ব্যবসাও আসছে না। মতিন আলোর ‘অনৈতিক’ কর্মকান্ডের আশংকায় চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর পর্ষদ দুজনকে বিদায় করে দেয়।
আলোর আগমনে ‘লোডশেডিং’ চলছে হোমল্যান্ড লাইফেও। ব্যবসা না দিতে দিতেই বাগিয়ে নিয়েছেন দায় দেনায় জর্জরিত হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর সীমাহীন (আনলিমিটেড) জ্বালানি তৈল ব্যয়ের ক্ষমতাসহ ব্যক্তিগত গাড়ি। ‘বন্ধুপ্রভু’ মতিনকে দিয়ে বাদ দিয়েছেন একাধিক প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা। গত ১১ জুলাই হোমল্যান্ড লাইফে যোগদান করা উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেনকে কোন কারণ ছাড়াই চাকরি থেকে বিদায় দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, ২ মাস ৮ দিনের বেতন না দিয়ে উন্নয়ন ও প্রশাসন বিভাগের এ কর্মকর্তাকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারে বড় ভূমিকা রাখেন লুৎফুন নাহার আলো।
বকেয়া আয়কর পরিশোধ না করা, ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ, ভূয়া শিক্ষা সনদধারী মোহাম্মদ আবদুল মতিনের নিয়োগ নিয়ে ভবিষ্যত করণীয় কি সে মতামতের জন্য হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন মোকাদ্দেসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। কোম্পানীর দীর্ঘ সময়ের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জুলহাসের বক্তব্য নেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোন কল গ্রহণ করেননি।
একটি সূত্র জানিয়েছে, বকেয়া আয়কর পরিশোধের জন্য কোম্পানিটির পক্ষ থেকে কর কমিশনার কার্যালয়ের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের কাছে এক মাসের সময় চাওয়া হয়েছে। ●
(হোমল্যান্ড লাইফের দ্বিতীয় পর্ব আসছে)
অকা/জীবীকো/বিপ্র/তাআ/দুপুর/২৩ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 6 months আগে