প্রণব মজুমদার ●
দেশের বীমা খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এর চেয়ারম্যান ড. এম. আসলাম আলম বিশেষ সাক্ষাৎকারে অর্থকাগজকে বলেছেন, দুর্বল কোম্পানিগুলোকে একীভূত করা সম্ভব নয়। এতে দুপক্ষের মধ্যে সমস্যা তৈরি হতে পারে! কেউই কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে নারাজ। ভালো-খারাপ যাই হোক- কোন পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত কেউই মানতে চায় না। ফলে কোম্পানিতে সমস্যা ও জটিলতা বাড়ে। তাছাড়া পুরানো দায় বা পাওনা পরিশোধে একীভূত কোম্পানির সময়ক্ষেপণ বা গড়িমসি করার সম্ভাবনা থাকে। বরং লাভজনক সামর্থ্যবান উদ্যোক্তা বা কোম্পানি দুর্বল বা অলাভজনক বীমা কোম্পানিকে কিনে নেওয়াই উত্তম সিদ্ধান্ত। সাম্প্রতিককালে দেখেছি, দেশের নন লাইফ কোম্পানি গ্রীন ডেলটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড সমস্যায় জর্জরিত এবং গ্রাহকের দাবী পরিশোধে ব্যর্থ সানলাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানিকে কিনে নিয়েছে। তেমনি দেশের প্রথম প্রজন্মের নন লাইফ কোম্পানি ইউনাইটেড ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর নতুন মালিক এখন ইউনাইটেড গ্রুপ।
দেশের বীমা খাতের ওপর ১৪ জানুয়ারি বিকেলে সোয়া এক ঘন্টার দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে প্রশ্ন উত্তর পর্বে তিনি নানা বিষয়ে তাঁর কর্ম পরিকল্পনা, দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যার সমাধান, শুদ্ধি অভিযান ও সংস্কার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেন। গত ১৪ জানুয়ারি বিকেলে রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এর তাঁর দফতরে বসে ছাত্র জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আসা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দীর্ঘ সময়ের এ সাবেক সিনিয়র সচিব ও বর্তমান আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. এম. আসলাম আলম বলেন, ‘নিষ্ঠার সঙ্গে আমি বীমা খাতের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করব।’ বীমা উদ্যোক্তা, ফোরাম, লাইফ ও নন লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমরা ধারাবাহিকভাবে বসে কথা বলেছি। তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন- বীমা খাতের মূল সমস্যাটা কোথায়? কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে ১৪ বছর। বীমা খাতের নিয়ন্ত্রকের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ৩৪টি লাইফ, ৪৬টি নন লাইফ এবং সংশ্লিষ্ট দফতরের জন্য নিযুক্ত নিয়ন্ত্রণকারী এ প্রতিষ্ঠানের জন্য মাত্র ১০০ জন জনবল রয়েছে! স্বল্প সংখ্যক জনবল নিয়ে বীমা খাতের কাজ সুচারুভাবে সম্ভব নয়। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে জনবল বৃদ্ধির জন্য সুনিদিষ্ট প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আশা করি তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিবেন।
ব্যাংক বীমাসহ দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দূরাবস্থা বিদ্যমান। ক্ষমতার বাইরে থেকে অনেক সমালোচনাই করা যায়। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অসংখ্যক দূরাবস্থার দ্রুত সমাধান বেশ কঠিন! বিগত সময়ে অনেক অনিয়ম হয়েছে এ খাতেও। দেশীয় বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। প্রভাব খাটিয়ে কাঁচা পয়সায় অযোগ্যদের কোম্পানি পরিচালনার বসানো হয়েছে। যোগ্যদের মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে ভালো কর্মী সৃষ্টি হয়নি এ খাতে। জবাবদিহিতা যেমন ছিল না; তেমনি প্রতিষ্ঠিত হয়নি সুশাসন। তিনি বলেন, প্রশাসন সুচারুভাবে পরিচালনা করার বিকল্প নেই। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোম্পানিগুলোকে আগের মতো কোন ধরনের অনুরোধ করব না। সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুদ্ধ অভিযান চলবে। কাজের স্বচ্ছতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইডিআরএ’র ওয়েবপেজ নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করা হচ্ছে। আমাদের কার্যক্রমের সকল তথ্য উপাত্ত ও পরিসংখ্যান পেইজে পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকসহ (সম্মান) স্নাতকোত্তর এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনীর নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক বিজ্ঞান ও নীতি বিষয়ে পিএইচডি এবং জাপান আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করা প্রশাসন ক্যাডারের ৩৬ বছরের কর্ম জীবনে নানা বিভাগ ও দফতরে দায়িত্ব পালন করা সজ্জন এ কর্মকর্তা অত্যন্ত আক্ষেপ করেন। অর্থকাগজকে তিনি বলেন, অন্যায়কারীদের বিরদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রকদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এ ক্ষেত্রে আইনের সংস্কারে প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন তিনি। মহামান্য আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ড. এম. আসলাম আলম বলেন, সুশাসন নিশ্চিত করতে গিয়ে বাধা আসে। অনিয়ম বা দুর্নীতিতে প্রমাণিত কোন ব্যক্তি বা কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল নিয়ন্ত্রক। পরে দেখা গেল অনিয়মকারী মহামান্য আদালতের শরণাপন্ন হয়ে আদেশের বিরুদ্ধে রিট করে বসেন। সে মামলার স্থিতাবস্থা নিয়ে অপরাধী দিনের পর দিন কর্ম সম্পাদন করে যান। এটা আর্থিক খাতের বড় সমস্যা।
বাজার পরিধির বিবেচনায় দেশের বীমা কোম্পানির সংখ্যা অনেক। বীমা দাবী পরিশোধে বিলম্ব, গ্রাহকের পাওনা পরিশোধে গড়িমসি, কোম্পানির তহবিল তছরূপ, মাত্রাতিরিক্ত কমিশন ও ব্যবস্থাপনা ব্যয়, ভূয়া শিক্ষা সনদে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বেআইনিভাবে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার চলতি দায়িত্ব পালন, সময়কালের অযোগ্যতা এবং দেশীয় কোম্পানির প্রতি গ্রাহকের আস্থার সংকট ইত্যাদি বিযয়গুলো উত্থাপন করা হলে তিনি বলেন, আপনি হলেন আর্থিক খাতের দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞ ও জ্ঞানবান সাংবাদিক। আপনিও জানেন দেশের অর্থনীতির বাস্তবতা। কি সমস্যা এবং এর কি সমাধান। তিনি বলেন, দেশে সুশাসন নিশ্চিত হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বীমা খাতে তা প্রতিষ্ঠা করতে। আর সে লক্ষ্যে সংস্কারমূলক কাজে আমরা মনোনিবেশ করছি। বেশ কিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থা এরিমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন। সামনে আরো কঠোর ব্যবস্থার কার্যক্রম দেখতে পাবেন। ফলে নিকট ভবিষ্যতে এ খাতের সুফল আমরা দেখতে দেখতে পাবো। আইডিআরএ’র ক্ষমতা সীমাবদ্ধ তা আগেও উল্লেখ করেছি। সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে কোম্পানির গ্রাহক ও অন্যান্যদের পাওনা আদায়ের ক্ষমতা আমাদের দেওয়া হয়নি। আর তা করাও ঠিক নয়। তবুও আমরা বীমা খাতের উন্নয়নে আশাবাদী। কেননা, বীমা মালিকগণ ও সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পেরেছেন, অতীতে যা ভুল হয়েছে তাতে তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। সবার সহযোগিতায় দেশের বীমা খাত ইতিবাচক রূপে অধিষ্ঠিত হবে বলে আমার বিশ্বাস ●
অকা/বিসা/বীখা/আলাপন/সকাল/২০ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
reporterpranab@gmail.com
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 months আগে