অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের উপর নতুন করে শুল্ক বসালে অনেকেই ভাবেননি, এর সরাসরি প্রভাব বাংলাদেশের সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর কিংবা চট্টগ্রামের পোশাক কারখানায় এসে পড়বে। কিন্তু আন্তঃসংযুক্ত বৈশ্বিক বাণিজ্যের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে—এক দেশের জন্য সৃষ্টি হওয়া বাধা, অন্য দেশের জন্য পরিণত হচ্ছে সম্ভাবনায়।
আমেরিকান পোশাক ক্রেতারা, যারা এতদিন চীনা উৎপাদন কেন্দ্রের উপর নির্ভর করতেন, এখন নতুন সরবরাহ উৎস খুঁজতে বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন। তারা sourcing-strategy পাল্টে নিজেরা ঢাকায় এসে কারখানা ঘুরে দেখছেন, স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে বসছেন এবং উপকরণ সরবরাহ সম্পর্কে খুঁটিনাটি যাচাই করছেন। এতে বাংলাদেশের প্রতি নতুন এক আস্থার ইঙ্গিত মিলছে।
রফতানিকারকদের মতে, এই প্রবণতা নিছক কাকতালীয় নয়। বাংলাদেশের শক্তিশালী পোশাক রফতানি সক্ষমতা, প্রতিযোগিতামূলক খরচ এবং দক্ষ শ্রমশক্তির কারণে দেশটি এখন বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক হিসেবে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে।
দেশের শীর্ষ ১০ জন শীর্ষ রফতানিকারকের মধ্যে চারজন নিশ্চিত করেছেন—মার্কিন ক্রেতারা তাদের সঙ্গে নতুন অর্ডার ও উৎপাদন সরিয়ে নেওয়া নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। যেসব প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই বাংলাদেশে কাজ করছিল, তারাও চীনের কিছু অর্ডার এখানেই স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে। টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, "গত সপ্তাহেই চীন-নির্ভর দুই মার্কিন ক্রেতা আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা এখানকার সরবরাহ চেইন যাচাই করে অর্ডার বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ইঙ্গিত।"
শুধু মার্কিন ক্রেতারাই নয়, শুল্ক-ঝুঁকি এড়াতে চীনের নিজস্ব টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস কোম্পানিগুলোও এখন বিদেশে বিকল্প খুঁজছে। বাংলাদেশ তাদের অন্যতম পছন্দ। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানিয়েছেন, গত দুই সপ্তাহে তিনটি চীনা এবং একটি জাপানি কোম্পানি তার সঙ্গে প্রাথমিক যোগাযোগ করেছে।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি মো. খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, তিনটি চীনা কোম্পানি সরাসরি টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী। চলতি মাসের শেষ দিকে একটি উচ্চপর্যায়ের চীনা প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে সম্ভাব্য বিনিয়োগ স্থানগুলো পরিদর্শন করবে।
তবে এমন এক সময়ে যখন বাংলাদেশ নতুন বাজার ও বিনিয়োগের দ্বারপ্রান্তে, তখনই বড় একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি সংকট। শিল্প নেতারা জানিয়েছেন, গ্যাস-নির্ভর কারখানাগুলো মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ পাচ্ছে। গ্যাসচাপ কোনো কোনো কারখানায় ১০ পিএসআই’র পরিবর্তে ০.৫ পিএসআই পর্যন্ত নেমে এসেছে, যা টিকে থাকা কঠিন করে তুলছে।
নারায়ণগঞ্জ ও আশুলিয়ার বেশ কিছু কারখানা এখন মাত্র ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট, লোডশেডিং এবং উচ্চমূল্যের ডিজেল ব্যবহারে খরচ বেড়ে যাওয়ায় নতুন অর্ডার নিতে সাহস পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।
এনজেড টেক্সটাইল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউদ জামান খান জিতু বলেন, "আমরা এখন গ্যাস, বিদ্যুৎ ও এলপিজির সম্মিলিত ব্যবস্থায় কোনোমতে কারখানা চালু রেখেছি। এই অবস্থায় পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করা সম্ভব নয়।"
এপ্রিলে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সাময়িকভাবে শুল্ক ১৫% থেকে বাড়িয়ে ৫২% করেছিল। পরে তা কমিয়ে ১০% করা হয়, তবে চীনের জন্য তা ১৪৫% পর্যন্ত বাড়ানো হয়, যা চীনা গার্মেন্টস খাতের জন্য বড় ধাক্কা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই শুল্কই বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে নতুন বাজার নিশ্চিত করতে পারে—যদি জ্বালানি ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা কাটানো যায়।
র্যাপিড-এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে, মার্কিন-চীন বাণিজ্য দ্বন্দ্ব সহজে থামবে না। ফলে ক্রেতারা বিকল্প উৎস খুঁজতেই বাধ্য হবেন। বাংলাদেশ এখানে অনেকটাই এগিয়ে।"
তিনি আরও বলেন, "কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, এমনকি ভারতেও চীনের বড় বিনিয়োগ থাকায় মার্কিন ক্রেতারা সেসব বাজারে যেতে দ্বিধায় থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো তুলনামূলকভাবে নির্ভরযোগ্য।"
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, "আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে দেশের জ্বালানি পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আমরা ইতোমধ্যে এলএনজি অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করেছি।"
বাণিজ্য উপদেষ্টা এসকে বশির উদ্দিন বলেন, "যে কোনো বৈদেশিক বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে এসে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস সুবিধা পাবেন—এই নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারবো শিগগিরই।"
সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য দ্বন্দ্বের ফাঁদে পড়ে সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ এবং কার্যকর অবকাঠামো। নতুবা সম্ভাবনার দরজায় পৌঁছেও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে পারে। ●
অকা/তৈপোশি/সকাল/ ৮ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 5 days আগে