অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
সরকার আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশের পুঁজি বাজারে নতুন গতি সঞ্চার করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এই বাজেটে বাজার-বান্ধব কর প্রণোদনার একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য হলো নতুন কোম্পানিগুলোকে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত করা, বিনিয়োগকারীদের জন্য করের সুবিধা বৃদ্ধি করা এবং সামগ্রিকভাবে বাজারে বিনিয়োগের আস্থা পুনরুদ্ধার করা।
এই প্রণোদনার আওতায় শেয়ার বাজারে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের জন্য কর ছাড়ের সীমা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে যে সীমিত কর রেয়াত সুবিধা বিদ্যমান, তা আরও সম্প্রসারিত করার কথা ভাবা হচ্ছে। বিশেষ করে ডিভিডেন্ড আয়ের ওপর কর রেয়াতে ছাড় বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অধিকতর উৎসাহিত হবেন এবং দীর্ঘমেয়াদে বাজারে অংশগ্রহণ বাড়বে।
তালিকাভুক্ত ও অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহারের ব্যবধান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করহার ৩৭.৫ শতাংশ এবং অ-তালিকাভুক্তদের জন্য ৪০ শতাংশ। এই ব্যবধান ৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব থাকলেও, ভবিষ্যতে তা ১০ শতাংশে উন্নীত করার চিন্তাভাবনা রয়েছে, যাতে আরও প্রতিষ্ঠান বাজারমুখী হয়।
বর্তমানে যেসব কোম্পানি ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) এর মাধ্যমে ছেড়েছে, তাদের করহার ২০ শতাংশ। আর যেসব কোম্পানির শেয়ার ১০ শতাংশ বা তার কম, তাদের ক্ষেত্রে করহার ২২.৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এই কর ব্যবধান আরও বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা প্রস্তাব করেছে, যেসব প্রতিষ্ঠান বছরে ১০ কোটি টাকার বেশি কর ছাড় গ্রহণ করে, তাদের শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হোক। এতে করে কর সুবিধার বিনিময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশীদার করার সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য নির্দিষ্ট মেয়াদে কর অবকাশ (ট্যাক্স হলিডে) সুবিধা চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে করে নতুন ও উদীয়মান কোম্পানিগুলোর বাজারে আসার আগ্রহ বাড়বে এবং উদ্যোক্তারা কর ছাড়ের সুবিধা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন।
এছাড়া মোবাইল ফোন অপারেটরদের ক্ষেত্রেও করহারে পরিবর্তনের চিন্তা করা হচ্ছে। বর্তমানে এ খাতে করহার ৪৫ শতাংশ, যা বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হতে পারে। সরকারের লক্ষ্য হলো—বাংলালিংক ও টেলিটকের মতো বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে বাজারে তালিকাভুক্ত হতে চাপ প্রয়োগ করা, যাতে তারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশীদার করে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে।
শেয়ার বাজার একটি দেশের অর্থনীতির আয়না। এখানে বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর আদায় এবং কর্মসংস্থানের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পুঁজি বাজার নানা সংকটে নিমজ্জিত—আস্থার অভাব, স্বল্পমেয়াদি মনোভাব, স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং নীতিগত অসামঞ্জস্য এর মূল কারণ। এমন বাস্তবতায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকার যে বহুমুখী কর প্রণোদনার পরিকল্পনা করছে, তা নিঃসন্দেহে সাহসী ও ইতিবাচক পদক্ষেপ।
তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলে দেয়, শুধুমাত্র কর ছাড় বা করহারের পার্থক্য যথেষ্ট নয়। এগুলোর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, স্পষ্ট নীতিমালা, প্রয়োগে সমন্বয়হীনতা ও তদারকির ঘাটতি বহু প্রতিশ্রুতিকে অর্থহীন করে তুলেছে। কর সুবিধার পাশাপাশি তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সুশাসন, হিসাব স্বচ্ছতা, উদ্যোক্তা ও পরিচালনা পর্ষদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করলে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা টেকসই হবে না।
বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়, বাজারে নতুন কোম্পানির আগমন এবং মোবাইল অপারেটরদের তালিকাভুক্তির প্রস্তাব শুধু রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল নয়, বরং এটি হতে পারে কর্পোরেট সংস্কৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। যদি সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করে, তবে এ উদ্যোগ শুধু শেয়ার বাজারকেই চাঙা করবে না, বরং সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনবে।
তাই এখন প্রয়োজন সুস্পষ্ট রোডম্যাপ, সময়সীমা নির্ধারিত বাস্তবায়ন কাঠামো এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তের প্রভাব মূল্যায়নের জন্য স্বাধীন পর্যবেক্ষণ। পুঁজিবাজারকে জাগিয়ে তুলতে হলে কথায় নয়, কাজে প্রমাণ দিতে হবে—এই বাজার আসলেই অর্থনীতির হৃদস্পন্দন। ●
অকা/পুঁবা/সকাল/ ১২ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 month আগে