অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিদেশি মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্থানীয় মুদ্রায় দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণের পথ আরও সহজ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার জারি করে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, এই পদক্ষেপ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, বিশেষত এমন সময় যখন বৈদেশিক বিনিয়োগে আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে উঠেছে।
সার্কুলারে বলা হয়েছে, যেসব বিদেশি মালিকানাধীন অথবা বিদেশি নিয়ন্ত্রিত কোম্পানি বিগত তিন বছর বা তার বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে উৎপাদন কিংবা সেবা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, তারা এখন থেকে স্থানীয় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আরও সহজ শর্তে টাকা ঋণ নিতে পারবে। তবে এজন্য কিছু শর্ত মানতে হবে—যেমন প্রচলিত ঋণ নীতিমালা, আর্থিক সূচক, একক ঋণগ্রহীতা সীমা এবং ঋণ ও মূলধনের অনুপাত ইত্যাদি।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি এসেছে ডেট-ইকুইটি রেশিও বা ঋণ ও মূলধনের অনুপাতের ক্ষেত্রে। আগে এই অনুপাত ছিল ৫০:৫০—অর্থাৎ উদ্যোক্তা যদি ৫০ শতাংশ নিজস্ব মূলধন নিয়ে আসতেন, তবে তিনি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ পেতে পারতেন। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই অনুপাত বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬০:৪০। অর্থাৎ এখন থেকে উদ্যোক্তা ৪০ শতাংশ মূলধন আনলেই ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিবর্তন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করবে। কারণ, অধিকাংশ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে মধ্যম বা ছোট আকারের কোম্পানি, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে পুরো মূলধন বিনিয়োগে অনাগ্রহী থাকে। তারা চায় স্থানীয় উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা নিতে। এই নীতিগত শিথিলতা সেই পথ আরও সহজ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে দুটি মূল উদ্দেশ্য রয়েছে—
প্রথমত, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি সহায়ক ও প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক পরিবেশ তৈরি করা, যাতে তারা বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হয় এবং আগের বিনিয়োগ সম্প্রসারণে উদ্বুদ্ধ হয়।
দ্বিতীয়ত, দেশীয় উৎপাদন ও সেবা খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ ও আধুনিকায়নকে উৎসাহ দেওয়া, যাতে জাতীয় অর্থনীতিতে আরও প্রযুক্তি হস্তান্তর, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সম্ভব হয়।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিষ্কার করেছে, অন্যান্য সব ঋণ সংক্রান্ত নিয়ম ও শর্ত বহাল থাকবে। যেমন ঋণের উপযুক্ততা যাচাই, ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা, ঋণের উদ্দেশ্য যাচাই, মেয়াদ ও সুদের হার ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব আগের মতোই থাকবে। বিশেষ করে একক ঋণগ্রহীতা সীমা এবং ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার নীতিমালাও কঠোরভাবে মানতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকর তদারকি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, অতীতে কিছু বহুজাতিক কোম্পানি দেশীয় ঋণ সুবিধা নেওয়ার পর দায়মুক্ত থেকে গেছে, অথবা প্রকৃত বিনিয়োগে অর্থ ব্যয় না করে বিতর্কে জড়িয়েছে। তাই নতুন এই সুবিধার অপব্যবহার রোধে পর্যবেক্ষণ জোরদার করতে হবে।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে, এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে এসেছে যখন বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে, ডলার সংকট রয়েছে, এবং বৈদেশিক রিজার্ভ চাপের মুখে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী মুদ্রানীতির কড়াকড়ি ও ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখন উন্নয়নশীল দেশে নতুন বিনিয়োগের আগে সতর্কতা অবলম্বন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত সেই আস্থার সংকট কাটাতে এবং বিদেশি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনাকে আরও কার্যকর করতে সহায়ক হতে পারে।
এছাড়া বাংলাদেশে উৎপাদন খাতে যেমন গার্মেন্টস, ফার্মাসিউটিক্যালস, এগ্রো-বেইজড প্রডাকশন, এবং সেবা খাতে যেমন হোটেল-হাসপাতাল, টেলিকম ও সফটওয়্যার—এই সব খাতে বহু বিদেশি প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই কাজ করছে। নতুন এই ঋণসুবিধা তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো, প্রযুক্তি আপগ্রেড, নতুন ইউনিট স্থাপন, কিংবা অঞ্চলভিত্তিক সম্প্রসারণে সহায়ক হবে।
সার্বিকভাবে, এই নীতিগত শিথিলতা একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। তবে এটি যেন কেবল নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় ব্যবহৃত না হয় এবং প্রকৃত উৎপাদনমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে কাজে লাগে—সেটি নিশ্চিত করাই হবে সরকারের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৩ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে