অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
আইনি স্পষ্টতা ও যথাযথ দিকনির্দেশনার অভাবে দেশের বীমা খাতে এখনও গঠন করা হয়নি কর্মীদের জন্য মুনাফায় অংশগ্রহণ তহবিল—ডব্লিউপিপিএফ (Workers’ Profit Participation Fund) । ফলে একদিকে শ্রম আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে, অন্যদিকে কোম্পানির প্রকৃত মুনাফার অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন হাজার হাজার কর্মী।
বীমা কোম্পানিগুলো নিজেদের ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান’ দাবি করে শ্রম আইনের আওতার বাইরে থাকতে চাইছে। তারা বলছে, এই খাত ‘শ্রমঘন নয়’ এবং দৃশ্যমান শ্রমিকের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম, তাই শ্রম আইন তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও বিষয়টির কোনো নিরসন না হওয়ায় এটি নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন।
বাংলাদেশের বর্তমান শ্রম আইন অনুযায়ী, যে কোনো কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন এক কোটি টাকা বা স্থায়ী সম্পদ দুই কোটি টাকার বেশি হলে, সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ডব্লিউপিপিএফ তহবিল গঠন বাধ্যতামূলক। প্রতি বছর কোম্পানির কর-পরবর্তী মুনাফার ৫% এই তহবিলে জমা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এর মধ্যে ৮০% অর্থ সরাসরি কর্মীরা, ১০% কোম্পানির শ্রমিক কল্যাণ তহবিল এবং বাকি ১০% সরকার পরিচালিত শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা হওয়ার কথা।
আইনে এই বিধান স্পষ্ট থাকলেও দেশের ৩৫টি জীবন বীমা ও ৪৫টি সাধারণ বীমা কোম্পানি এখনও ডব্লিউপিপিএফ গঠন করেনি। তাদের দাবি, তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শ্রম আইন থেকে অব্যাহতি পাওয়ার অধিকার রাখে। অথচ এখনো পর্যন্ত আইনগতভাবে বীমা খাতকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
২০১৬ সালের ৯ মার্চ ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৭ সালে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডব্লিউপিপিএফ গঠনের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়। কিন্তু বীমা খাতের জন্য এ ধরনের কোনো নির্দেশনা এখনও দেয়নি বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) আইডিআরএর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগেও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রায় ৮০টি বেসরকারি বীমা কোম্পানি ‘চিঠি পাঠানো হয়েছে’ বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে এবং শ্রম আইন পরিপালন না করে তহবিল গঠনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অথচ এসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ও সম্পদ পরিমাণ শ্রম আইনে উল্লিখিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি, যার ভিত্তিতে ডব্লিউপিপিএফ গঠন তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।
এমন বাস্তবতায় নিরীক্ষকরা বারবার তাদের আর্থিক প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করছেন। যেমন, মেঘনা ইন্স্যুরেন্সের ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়া আর্থিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলে নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা কোম্পানিগুলোর এ ধরনের আচরণ শ্রম আইন লঙ্ঘনের শামিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষা করে তারা কার্যত কর্মীদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ রহস্যজনকভাবে নীরব থাকায় সমস্যার কোনো সমাধান আসছে না। এতে প্রায় ১০ লাখ কর্মী তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এবং একই সঙ্গে সরকারি শ্রমিক কল্যাণ তহবিলও হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্ভাব্য রাজস্ব। ●
অকা/বী/সকাল/ ৫ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে