অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। অর্থবছরের হিসাবে এই প্রবাহ বর্তমানে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে এই হার ঋণাত্মক ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে সামান্য উন্নতি পরিলক্ষিত হলেও, প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২.৬৩ শতাংশ, যেখানে গত অর্থবছরের একই সময়ে এই হার ছিল ৫.৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ, গত অর্থবছরের তুলনায় বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৩ শতাংশ কম। অথচ, চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে আগামী জুনের মধ্যে এই খাতে ৯.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অর্জন করা বেশ কঠিন বলে মনে হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে অর্থবছরের শুরুতে বেসরকারি খাতে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল, তা অনেকাংশে দূরীভূত হয়েছে। রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ডলার সংকট হ্রাস পাওয়ায় আমদানিও সহজ করা হয়েছে, যার ফলে আমদানির পরিমাণ বাড়ছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহও পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে এবং ভবিষ্যতে এই হার আরও বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বেসরকারি খাতে প্রত্যাশিত হারে ঋণপ্রবাহ না বাড়ার জন্য মূলত চারটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো: বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিদ্যমান অনিশ্চয়তা, অর্থবছরের শুরুতে তীব্র ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যাহত হওয়া, ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের ফলে ঋণ বিতরণের সক্ষমতা হ্রাস এবং সরকার পরিবর্তনের পরবর্তী সময়ে দেশে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা।
সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক ও ডলার সংকটের প্রভাবে অর্থবছরের শুরুতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ঋণাত্মক ছিল, যা এক পর্যায়ে -০.৫৭ শতাংশ পর্যন্ত নেমেছিল। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক সংস্কার ও ডলার সংকট নিরসনে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সেপ্টেম্বর মাস থেকে ঋণপ্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে ঋণপ্রবাহ ০.৬৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। জুলাই-অক্টোবরে তা আরও বেড়ে ১ শতাংশের নিচে অবস্থান করে। জুলাই-নভেম্বরে এই হার ১.৫ শতাংশে পৌঁছায় এবং চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে তা ২.৬৩ শতাংশে উন্নীত হয়। বিপরীতে, গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.৫৩ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এর ফলে বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো হচ্ছে এবং ঋণের সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। এই কারণে চাইলেও ঋণপ্রবাহ দ্রুত বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে নেমে এলে টাকার প্রবাহ বৃদ্ধি করা হবে এবং ঋণের সুদের হার কমানো হবে, যার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়বে। কর্তৃপক্ষের মতে, বর্তমানে ডলার সংকট কেটে গেছে এবং আমদানি অবাধ করা হয়েছে, ফলে আমদানি বাড়ছে। যেখানে পূর্বে আমদানির প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ছিল, সেখানে গত জুলাই-মার্চে আমদানি ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন এলসি খোলা বেড়েছে ৪.৫ শতাংশ, রফতানির জন্য কাঁচামাল আমদানি ২১.১১ শতাংশ এবং এলসি খোলা ১৩.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই কারণে ভবিষ্যতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়। তবে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেকের মধ্যেই সংশয় রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে কৃষি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। শিল্প খাতে সামান্য বৃদ্ধি পেলেও, মূল ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়েনি। আগের ঋণের ওপর আরোপিত সুদসহ মোট ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে নতুন ঋণ বিতরণ হ্রাস পেয়েছে। কোভিড-১৯ pandemic-এর সময় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল। সেই সময়ে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৫.১৩ শতাংশে নেমে আসে। এরপর, ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে এই হার বেড়ে ৭.৫৭ শতাংশে উন্নীত হয়। তবে, এরপর থেকে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের হার ক্রমশ কমছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা আরও কমে ৬.১৩ শতাংশে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫.৫৩ শতাংশে নেমে আসে। চলতি অর্থবছরে এই হার আরও কমে ২.৬৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, চলতি অর্থবছরসহ গত টানা তিন অর্থবছর ধরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, বৈদেশিক বাণিজ্যে ঋণপ্রবাহ বাড়েনি, বরং হ্রাস পেয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো বৈদেশিক বাণিজ্যের ঋণের একটি বড় অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় প্রদান করা হয়। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম দেখাচ্ছে, যদিও টাকার হিসাবে তা বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে, বেসরকারি খাতে এক ধরনের মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যার ফলে কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং শিল্প খাতে উৎপাদন কমছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ হ্রাসের পাশাপাশি মোট অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। ব্যাংক খাতে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে দেশের অভ্যন্তরীণ ঋণপ্রবাহ ৪.৫৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা গত অর্থবছরে ৪.৩১ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ২.২১ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণও হ্রাস পেয়েছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের ওই সময়ে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণ ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা গত অর্থবছরে ৯ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরের একই সময়ে মাত্র ২.০৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ●
অকা/প্র/সকাল/ ১১ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 month আগে