অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে ১ নম্বর অগ্রাধিকারে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেট সাজাচ্ছে সরকার। বাজেটে সুযোগ তৈরি করা হবে গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মসংস্থানের। এ জন্য উজ্জীবিত করা হবে রাস্তাঘাট নির্মাণ, সংস্কারসহ গ্রামীণ অবকাঠামো খাতের কর্মযজ্ঞকে। তবে বড় তেমন কোনো প্রকল্প নেয়া হবে না। তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় ভাতা কিছুটা বাড়ানো হবে। এমনকি বাড়ানো হবে ভাতাভোগীর সংখ্যা। সবই করা হবে সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকেও।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজস্ব সংগ্রহের বড় কোনো উৎসের সন্ধান না পাওয়ায় আগামী বাজেট তেমন বড় করা হচ্ছে না। এ কারণেই চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থ বছরের মূল বাজেটের আকার কমানো হচ্ছে অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা। অহেতুক উচ্চাভিলাষী নয়; বরং একটি বাস্তবভিত্তিক বাজেটের দিকেই এগোচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন ২ জুন। প্রতি অর্থ বছরে জুন মাসের কোনো বৃহস্পতিবারকে বাজেট ঘোষণার জন্য বেছে নেয়া হয়। এবারই তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। তবে বাজেট ঘোষণার পরদিন রেওয়াজ অনুযায়ী অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলন ঠিকই করবেন অর্থ উপদেষ্টা।
বাজেট মোটামুটি চূড়ান্ত করার জন্য সচিবালয়ে ১৫ এপ্রিল অনলাইনে আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার-সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিল ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠক করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেয়া হতে পারে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
রাজনৈতিক সরকারের অর্থমন্ত্রীরা বাজেট উপস্থাপন করে থাকেন জাতীয় সংসদে। সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট উপস্থাপন করবেন টেলিভিশনের পর্দায়। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ১৬ এপ্রিল বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি (নিয়ন্ত্রণকে) প্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট করতে যাচ্ছি। এ ছাড়া নজর থাকবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সাশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বাজেটে। চাইব মানুষের জীবনযাত্রা যেন সহজ হয়।’
এত কিছু কীভাবে করবেন, রাজস্ব তো বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা কম—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী অর্থ বছরে রাজস্ব বাড়বে। তবে মানুষের ওপর অহেতুক করের বোঝা বাড়াব না।’
সূত্রগুলো জানায়, চলতি অর্থ বছরের মতো ২০২৫-২৬ অর্থ বছরেও বাজেট–ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হবে। আগামী অর্থ বছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কিছুটা কমিয়ে ইতিমধ্যে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে থাকবে।
জানা গেছে, এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হবে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। বরাদ্দের দিক থেকে আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা এবং শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রতিফলন থাকবে বাজেটে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে, যা চলতি বাজেটে ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে চলতি অর্থ বছরের লক্ষ্য কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ২১ হাজার ৮১৭ টাকা, কিন্তু আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব–ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ২১ শতাংশ।
বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব আয় চার লাখ কোটি টাকা করতেই ঘাম ছুটে যায়। সে বিবেচনায় ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের বাজেটও উচ্চাভিলাষী হবে। এতে ঘাটতি বড় হবে। এটা কোনোভাবেই ছোট বাজেট হবে না, মূল্যস্ফীতি কমার বাজেটও হবে না, এমনকি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ার বাজেটও হবে না। তিনি বলেন, সাত হাজার কোটি টাকা কমানোর কথা বলা মানে হচ্ছে, কল্পনার সঙ্গে কল্পনার তুলনা করা। অনেকটা এ রকম—আগের সরকার চাঁদে যাওয়ার কথা বলেছিল, এখন বলা হবে মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার কথা।
দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যা ৯–১০ শতাংশের ঘরে থাকছে। সূত্রগুলো জানায়, নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকবে। সরকার প্রথমে আগামী অর্থ বছর শেষে এ হার ৭ শতাংশে নামিয়ে আনবে বলে ঠিক করেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় এ হার আরও কমবে বলে সরকার আত্মবিশ্বাসী। ●
অকা/আখা/ফর/দুপুর/১৭ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 weeks আগে