তারেক আবেদীন ●
অনিয়মের আরেক নাম রিপাবলিক ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড। অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অন্য কোম্পানি থেকে বহিস্কৃত এমডিকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ, `ডামি কর্মকর্তাদের’ মাধ্যমে কমিশন ও পারিতোষিক হাতিয়ে নেওয়া এবং কোম্পানির চেয়ারম্যানের গাড়িচালককে ভিপি পদে সরাসরি নিয়োগ দিয়ে শাখা পরিচালনা করার মতো অনেক অভিযোগ ২০০০ সালের ১৮ মে প্রতিষ্ঠিত দেশের নন লাইফ কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। কোম্পানিটির বর্তমান শাখা ৩৯টি। সারা দেশে এসব শাখার মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১১টি শাখা বিধিবদ্ধ এলাকার মধ্যে নেই। বীমা খাতের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনেকদিন ধরে কোম্পানির চেয়ারম্যান ও পোষ্য এমডি অবৈধভাবে এ ব্যবসা করে আসছে বলে লোকমুখে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, রাজধানীর কাকরাইলস্থ কোম্পানির নিবন্ধিত প্রধান কার্যালয়ের আশেপাশে অন্য এলাকার নামে একাধিক শাখা রাখার বিধান না থাকলেও পর্ষদ চেয়ারম্যান ও উর্দ্ধতন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারি রাখার উদ্দেশ্যে এ জাতীয় ‘ডামি শাখা’ খোলা হয়েছে। এ নিয়ন্ত্রণের পিছনে কাজ করছে ক্ষমতাবান কর্মকর্তাদের অনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। এর মাধ্যমে কমিশন ও মুনাফা হাতিয়ে নেওয়া।
জানা গেছে, রিপাবলিক ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর মহানগরী ঢাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামে অবস্থিত ১১টি শাখা যথাস্থানে নেই! শাখাগুলোর অবস্থান হচ্ছে- রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের শাখা ১৫ নম্বর বেইলী রোডে, মালিবাগ শাখা ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউ শাখা ২৩ নম্বর কাকরাইলে, হাটখোলা শাখা ১৬১ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায়, মতিঝিল শাখা ১৫ দিলকুশায়, ইমামগঞ্জ শাখা ৮১/বি/১ চাঁনখারপুলে, ফার্মগেট শাখা কারওয়ান বাজারে, রামপুরা শাখা ৮০/এ সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডে অবস্থিত। আর চট্টগ্রামের তিনটি শাখা কার্যালয়ও যথাস্থানে নেই। খাতুনগঞ্জ ও জুবলি রোড শাখার কার্যালয় ১৮ নম্বর আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় এবং লালদীঘি শাখা কার্যালয়ের অবস্থান ৮০ নম্বর খাতুনগঞ্জে।
কোম্পানির ওয়েবসাইটে ৩৯টি শাখার ম্যানেজার হিসেবে ৩৬ জন কর্মকর্তার নাম, ফোন ও ইমেইল নম্বর প্রদর্শিত হলেও আজ (১ জানুয়ারি, ২০২৫) ৫ জনের ছবি দেখা যাচ্ছে না। তবে ৩ দিন আগে (২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪) ১৩ জন কর্মকর্তার ছবি ছিল না যা নতুনভাবে যুক্ত করা হয়েছে।
অর্থকাগজ এর প্রতিবেদক রিপাবলিক ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর মালিবাগ ও বঙ্গবন্ধু এভিনিউ শাখায় একাধিকবার সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। তিনি কখনই দুই শাখার ব্যবস্থাপকদের সাক্ষাৎ পাননি। রাজধানীর কাকরাইল প্রধান কার্যালয়ের (এইচ আর ভবন, ২৬/১, কাকরাইল, ঢাকা) সন্নিকটে ২৩ নম্বর কাকরাইলস্থ হালিমুননেসা কোর্টের ৪র্থ তলায় মালিবাগ শাখা এবং একই ভবনের ৭ম তলায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ শাখায় আজ গিয়েও তাদের অনুপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। মালিবাগ শাখা ব্যবস্থাপক রুমা আক্তারের (কোম্পানির চেয়ারম্যান হানিফ চৌধুরীর নিয়োগপ্রাপ্ত গাড়িচালক খন্দকার সোহেল রানার স্ত্রী) কাঁচের স্বচ্ছ দেয়ালে আবৃত চেম্বারটি অন্ধকার অবস্থায় রয়েছে। শাখায় ৩ জন বীমা কর্মীকে দেখা যায়। শাখা ব্যবস্থাপক রুমা আক্তার কোথায় জানতে চাইলে শাখার অবলিখন কর্মকর্তা শহীদুল করিম জানান, উনি ব্যবসার কাজে বাইরে আছেন। মাঝে মধ্যে আসেন। ৪ ডিসেম্বর অর্থকাগজ পোর্টালে ‘চাকরি বিধি লংঘন করে রিপাবলিক ইনস্যুরেন্স ভিপি পদে গাড়িচালক’ শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে প্রতিবেদক জানতে পারেন কোম্পানির এসইভিপি পদের এ রুমা আক্তার রিপাবলিক ইনস্যুরেন্সের একজন ‘ডামি কর্মকর্তা’। তার স্বামী প্রাক্তন গাড়িচালক ভিপি খন্দকার সোহেল রানা স্ত্রীর পক্ষে কর্ম সম্পাদন করেন। সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) পদ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ শাখা ব্যবস্থাপক অঞ্জনা বসাকও একজন ‘ডামি কর্মকর্তা’ বলে অভিযোগ। তার স্বামী কোম্পানির ডিএমডি ও কোম্পানি সচিব সুজন কুমার বসাক স্ত্রীর হয়ে তার কাজগুলো নির্বাহ করেন। সরেজমিনে গিয়ে এ শাখায় গিয়ে দেখা যায় ছোট্ট একটি কক্ষে তিনটে টেবিল ও চেয়ার। অ্যাটেনড্যান্ট (পিয়ন) পরিচয়দানকারী বছরখানেক ধরে কোম্পানির এ শাখায় চাকরিরত জামালপুর মাদারগঞ্জের রিপন হাসান (২১) জানান, ম্যাডাম আসেন মাসে একবার কি দুবার। মাস শেষে অফিসে এসে কর্মকর্তা/কর্মচারি হাজিরা খাতায় এক মাসের স্বাক্ষর একবারে দিয়ে টাকা তুলে নিয়ে যান। ওনার হয়ে কাজ সারেন হেড অফিসের একজন বড় স্যার। এসব ‘ডামি কর্মকর্তাদের’ মুখোমুখি দাঁড় করালেই থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে।
বিষয়টি নিয়ে রিপাবলিক ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা লায়ন ড. একেএম সরোয়ার জাহান জামিলের মন্তব্য নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু সংযোগ না হওয়ায় তার মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি।
কোম্পানির নিরপেক্ষ পরিচালক ড. সুবর্ণ বড়ুয়াকে অনিয়মগুলো তুলে ধরে তার মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিনি অর্থকাগজকে বলেন, গ্রাহক বা মক্কেল যদি সুনিদিষ্টভাবে অভিযোগ করেন; তাহলে আমরা অবশ্যই কোম্পানির পর্ষদে আলোচনা করে তা সমাধান করব। কোম্পানি সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। রিপাবলিক ইনস্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেড এর মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে একটি কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন চেয়ারম্যান ও এমডি যৌথভাবে কোন কাজ সম্পাদন করলে পর্ষদের অন্য পরিচালকদের করার কিছুই থাকে না। ●
অকা/বিপ্র/সাবী/ই/রাত/১ জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 months আগে