অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা বেসরকারি খাতের পাঁচটি ইসলামি ব্যাংকের নতুন নাম নির্ধারিত হয়েছে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’। এই নামেই গঠিত হবে নতুন বৃহৎ ইসলামি ব্যাংক, যেখানে পাঁচটি ব্যাংকের সম্পদ ও দায় একত্রিত করে নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানান্তর করা হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই নতুন ব্যাংক গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সরকারের পক্ষে ব্যাংকটির মালিক হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে সম্পন্ন হবে—প্রথমে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ নামে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হবে, এরপর যৌথ মূলধনী কোম্পানিজ ও ফার্মস বিভাগ থেকে নিবন্ধন সম্পন্ন করা হবে। সর্বশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নতুন ব্যাংক ব্যবসার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা হবে।
একীভূতকরণের পটভূমি
গত এক দশকে অনিয়ম, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কয়েকটি ইসলামি ব্যাংক গুরুতর আর্থিক সংকটে পড়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নজিরবিহীন অর্থলুণ্ঠনের ফলে এসব ব্যাংকের তারল্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করে, যার পরিণতিতে পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করে নতুন ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং উপদেষ্টা পরিষদ ইতোমধ্যেই এ প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে। প্রক্রিয়ায় থাকা ব্যাংকগুলো হলো—ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল) এবং এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংক অব বাংলাদেশ (এক্সিম ব্যাংক)।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং দৈনন্দিন লেনদেন পরিচালনাতেও সংকটে পড়েছে। ফলে সরকার মনে করছে, একীভূত হয়ে একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী ইসলামি ব্যাংক গঠন ছাড়া বিকল্প পথ নেই।
নাম নির্বাচন প্রক্রিয়া
প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ব্যাংকের জন্য ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ নাম প্রস্তাব করেছিল এবং উপদেষ্টা পরিষদে সেই নাম পাঠানো হয়। তবে আলোচনার পর পরিষদ বিকল্প হিসেবে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ নাম প্রস্তাব করে। পরবর্তীতে এই নামই চূড়ান্ত অনুমোদন পায় এবং এখন থেকে নতুন ব্যাংকের সব প্রক্রিয়া এই নামেই সম্পন্ন হবে।
মূলধন কাঠামো ও আর্থিক ভিত্তি
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী নতুন ব্যাংক স্থাপনে ন্যূনতম ৫০০ কোটি টাকার মূলধন প্রয়োজন হলেও ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’-এর মূলধন কাঠামো হবে এর বহু গুণ বেশি। প্রস্তাবিত ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা এবং অনুমোদিত মূলধন ৪০ হাজার কোটি টাকা—যা মূলধনের দিক থেকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক হিসেবে স্থান পাবে।
এই মূলধনের মধ্যে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা প্রদান করবে, যার অর্ধেক নগদ অর্থে এবং বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুক বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে বাজার থেকে সংগ্রহ করা হবে। অবশিষ্ট ১৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে একটি অংশ আমানত সুরক্ষা তহবিল থেকে এবং অন্য অংশ করপোরেট আমানতকারীদের শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে।
আমানত ফেরত ও পুনঃস্থাপন পরিকল্পনা
নতুন ব্যাংকের মূলধনের বড় অংশই ব্যয় হবে পূর্ববর্তী ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের বকেয়া অর্থ পরিশোধে। দুই লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতের ক্ষেত্রে অর্থ প্রদান করা হবে আমানত সুরক্ষা তহবিল থেকে, এবং বড় অঙ্কের আমানত পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করা হবে নতুন ব্যাংকের তহবিল ও আয়ের ভিত্তিতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, সরকারি মালিকানায় পরিচালিত এই নতুন ব্যাংক ইসলামি ব্যাংক খাতে নতুন আস্থা ফিরিয়ে আনবে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাতে আমানত প্রবাহ যে ধীরে ধীরে বাড়ছে, তা বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে—‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’-এর প্রতি সাধারণ মানুষ ও প্রবাসী আমানতকারীদের আগ্রহ দ্রুত বাড়বে।
সম্ভাব্য প্রভাব
সরকারি মালিকানার কারণে ব্যাংকটি শুধু আর্থিক স্থিতিশীলতাই নয়, ইসলামি ব্যাংকিং খাতে নীতি ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর নতুন মানদণ্ড স্থাপন করতে পারে। তাছাড়া প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সংগ্রহ এবং ইসলামী অর্থায়নের নতুন পণ্য প্রবর্তনের মাধ্যমে ব্যাংকটি তারল্য ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/২৩ অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 8 hours আগে