অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) করদাতাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সীমিত তথ্য সরাসরি সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। কর ফাঁকি রোধ, রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রস্তাবটি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী করদাতাদের রিটার্নে বাধ্যতামূলকভাবে উল্লেখ করার জন্য প্রয়োজনীয় তিন ধরনের তথ্য—বার্ষিক সুদ আয়, উৎসে কর্তনকৃত কর (টিডিএস) এবং অর্থবছরের শেষ দিনে ব্যাংক ব্যালান্স—রিয়েল-টাইমে এনবিআর পাবে। এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য সংগ্রহের দাবি করা হয়নি বলে সংস্থাটি জানিয়েছে।
বর্তমানে করদাতাদের আলাদাভাবে প্রতিটি ব্যাংক থেকে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে হয়, যা অনেক সময় জটিলতা সৃষ্টি করে। নতুন ব্যবস্থা কার্যকর হলে এসব তথ্য সরাসরি এনবিআরের অনলাইন সিস্টেমে যুক্ত হবে। এতে করদাতাদের ঝামেলা কমবে এবং একই সঙ্গে লুকানো আয় বা গোপন হিসাব ধরা সহজ হবে। এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করছেন, সৎ করদাতারা এ উদ্যোগ থেকে উপকৃত হবেন, আর কর ফাঁকিদাতাদের জন্য এটি একটি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে।
কর বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টিকে সময়োপযোগী মনে করছেন। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এস. কে. জামি চৌধুরীর মতে, এটি কর ব্যবস্থাকে আধুনিক করবে এবং রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা আনবে। তবে তিনি সতর্ক করেছেন, একবার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তথ্যের সঙ্গে এনবিআরের সংযোগ তৈরি হলে ভবিষ্যতে নগদ লেনদেনেও সীমাবদ্ধতা আরোপের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে কর বিশেষজ্ঞ নিজাম উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বর্তমান ব্যবস্থায় অনেক করদাতা ব্যাংক হিসাব আড়াল করে কর ফাঁকি দেন, কিন্তু প্রস্তাবিত ব্যবস্থা কার্যকর হলে তা আর সম্ভব হবে না।
তবে ব্যাংকাররা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, করদাতাদের ব্যাংক তথ্য একাধিক সংস্থা বা কর্মকর্তার হাতে গেলে তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এতে গ্রাহকরা ব্যাংকে অর্থ রাখার বিষয়ে আস্থা হারাতে পারেন, যা ব্যাংক আমানতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আইসিএবির সাবেক সভাপতি শাহাদাৎ হোসেনও একই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, তথ্য অ্যাক্সেসের সুযোগ থাকলেও তা শুধু নির্দিষ্ট অনুমোদিত কর্মকর্তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
আইনগত দিক থেকেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী গ্রাহকের তথ্য গোপন রাখা বাধ্যতামূলক। ফলে এনবিআরের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে এ আইনে সংশোধন আনতে হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, বিদেশের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে এবং আইনগত কাঠামো পর্যালোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টিআইএনধারী রয়েছেন, যার মধ্যে গত বছর রিটার্ন দাখিল করেছেন প্রায় ৪৫ লাখ জন। এর মধ্যে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন ১৫ লাখ করদাতা। এবছর থেকে প্রায় সবার জন্যই অনলাইন রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকের সঙ্গে রিয়েল-টাইম তথ্য সংযুক্ত হলে রিটার্ন প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কর ফাঁকি রোধে এটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। তবে ব্যাংকারদের শঙ্কা অমূলক নয়, কারণ তথ্য নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত না হলে সাধারণ আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তাই প্রস্তাব কার্যকর হওয়ার আগে আইনগত সুরক্ষা, প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা এবং এনবিআরের প্রয়োগ কৌশল কতটা শক্তিশালী হবে—তা-ই নির্ধারণ করবে উদ্যোগটির সফলতা। ●
অকা/রা/ই/সকাল/২০আগস্ট, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 months আগে