অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস খাত তার কৌশলগত গুরুত্ব বজায় রেখেছে। গত দুই দশকে এই খাতটি দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পায়ন, কৃষি (বিশেষ করে সার শিল্প), এবং গৃহস্থালীর জ্বালানি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে, একদিকে যেখানে দেশীয় ও বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই খাতের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, সেখানে অপর্যাপ্ত মজুদ, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি না থাকা, অনুসন্ধান কার্যক্রমের অভাব, ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা এবং সুষম নীতির অভাব দেশটির প্রাকৃতিক গ্যাস খাতকে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
পেট্রোবাংলা–এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক:
পরিসংখ্যান | পরিমাণ | মন্তব্য |
---|---|---|
মোট রিজার্ভ (আনুমানিক) | ২৮.৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (TCF) | ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রাক্কলিত মোট মজুত। |
উত্তোলিত | ২০.৪ TCF | এ পর্যন্ত উত্তোলনকৃত মোট গ্যাসের পরিমাণ, যা মোট রিজার্ভের প্রায় ৭১.৮%। |
অবশিষ্ট উত্তোলনযোগ্য | আনুমানিক ৭–৮ TCF | বর্তমান প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় উত্তোলনযোগ্য প্রাক্কলিত মজুত। এই পরিমাণ ভবিষ্যতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বাজার মূল্যের পরিবর্তনে সামান্য বাড়তে পারে। |
দৈনিক চাহিদা | ৩৮০০–৪২০০ মিলিয়ন ঘনফুট (MMCFD) | বিভিন্ন খাত মিলিয়ে দেশের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা। গ্রীষ্মকালে এবং শিল্পোৎপাদনের ঊর্ধ্বগতির সময়ে এই চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। |
বর্তমান উত্তোলন | ২৭০০ MMCFD | দেশের বর্তমান দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ক্ষমতা, যা চাহিদার তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। |
দৈনিক ঘাটতি | প্রায় ১১০০ MMCFD | দৈনিক চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যেকার বিশাল ব্যবধান, যা শিল্প, বিদ্যুৎ ও গৃহস্থালী খাতে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। |
এই পরিসংখ্যান স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস খাত একটি গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে। উত্তোলনযোগ্য মজুতের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, অথচ দৈনিক চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলস্বরূপ, দৈনিক প্রায় ১১০০ MMCFD গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এই গভীর সংকটের মূলে একাধিক কারণ বিদ্যমান:
দীর্ঘমেয়াদী অনুসন্ধানে অনীহা ও বিনিয়োগের অভাব: গত দুই দশকে বাংলাদেশে নতুন ও বড় গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখা যায়নি। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব এবং দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনুসন্ধান কার্যক্রম গতি পায়নি। স্থলভাগ এবং অগভীর সমুদ্রের সম্ভাবনাময় ব্লকগুলোতে পর্যাপ্ত জরিপ ও খনন কাজ করা হয়নি।
পুরনো গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন হ্রাস: দেশের বিদ্যমান ২৭টি গ্যাসক্ষেত্রের অধিকাংশই এখন তাদের উৎপাদন চক্রের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, যা সামগ্রিক গ্যাস সরবরাহের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা: গ্যাস উত্তোলন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিতরণ ব্যবস্থায় অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। লিকেজ এবং সিস্টেম লসের কারণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাস অপচয় হয়, যা ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
দুর্বল নীতি ও নিয়ন্ত্রক কাঠাম: গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং বিতরণের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী, কার্যকর এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতি ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অভাব রয়েছে। আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করার জন্য প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা এবং একটি স্থিতিশীল বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা যায়নি।
চাহিদার দ্রুত ঊর্ধ্বগতি: দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্পায়নের বিস্তার এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে গ্যাসের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে গ্যাসের উপর অত্যধিক নির্ভরতাও একটি বড় কারণ।
আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধি: ক্রমবর্ধমান ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দিকে ঝুঁকছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয় অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতার উপর নির্ভরশীল, যা দেশের অর্থনীতিতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।
অবকাঠামোগত দুর্বলতা: গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং বিতরণের জন্য পর্যাপ্ত ও আধুনিক অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। নতুন কূপ খনন এবং উত্তোলিত গ্যাস পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় পাইপলাইন এবং অন্যান্য সুবিধাগুলির উন্নয়ন ধীরগতিতে হচ্ছে।
যদি এই সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ভবিষ্যতে আরও কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে, যার সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব পড়তে পারে:
শিল্প উৎপাদনে বাধা: গ্যাসের অভাব শিল্প কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যাহত করবে, যার ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। সার কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ কমে গেলে কৃষি উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিদ্যুৎ সরবরাহে অনিশ্চয়তা: গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত গ্যাস না পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে, যা লোডশেডিং এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি: এলএনজি আমদানির উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে এবং বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে, যার প্রভাব সাধারণ মানুষের উপর পড়বে।
নতুন বিনিয়োগে অনীহা: জ্বালানি সরবরাহের অনিশ্চয়তা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করতে পারে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে মন্থর করে দেবে।
সামাজিক অস্থিরতা: জ্বালানি সংকট জনজীবনে দুর্ভোগ ডেকে আনতে পারে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
এই গভীর সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদী এবং কার্যকর কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য। নিম্নলিখিত বিস্তারিত সুপারিশগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:
জরুরি ভিত্তিতে নতুন গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া:
আকর্ষণীয় নীতি প্রণয়ন: আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করার জন্য একটি সুস্পষ্ট, স্থিতিশীল এবং বিনিয়োগবান্ধব নীতি কাঠামো তৈরি করতে হবে। উৎপাদন ভাগাভাগি চুক্তি (PSC) এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক চুক্তির শর্তাবলীকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে।
দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া: গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলন কার্যক্রমের জন্য অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বচ্ছ করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস করতে হবে।
প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বিনিয়োগ: গভীর ও অগভীর সমুদ্র এবং জটিল ভূতাত্ত্বিক কাঠামোয় অনুসন্ধানের জন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার করতে হবে।
দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি: পেট্রোবাংলার অনুসন্ধান এবং উত্তোলন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।
বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি:
উন্নত উত্তোলন প্রযুক্তি (EOR): পুরনো এবং সম্ভাবনাময় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উন্নত উত্তোলন প্রযুক্তি (Enhanced Oil Recovery) ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া।
কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার: উৎপাদন কমে যাওয়া কূপগুলোতে নতুন করে খনন (drilling) এবং বিদ্যমান কূপগুলোর কার্যকারিতা পুনরুদ্ধারের (workover) জন্য নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করা।
গ্যাস ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি ও অপচয় রোধ:
অবকাঠামো উন্নয়ন: গ্যাস উত্তোলন, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও উন্নয়ন করতে হবে। লিকেজ সনাক্তকরণ ও মেরামতের জন্য নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
মিটারিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ: সঠিক মিটারিং এবং বিলিং ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্যাসের অপচয় রোধ করা সম্ভব।
সচেতনতা বৃদ্ধি: শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক ব্যবহারকারীদের মধ্যে গ্যাস ব্যবহারের দক্ষতা এবং অপচয় রোধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো।
দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকর নীতি প্রণয়ন:
জাতীয় জ্বালানি নীতি পর্যালোচনা: দেশের সামগ্রিক জ্বালানি চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং বাস্তবসম্মত জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের ভূমিকা এবং বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি: গ্যাস খাত তদারকির জন্য একটি শক্তিশালী এবং স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন ও তার সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি:
নবায়নযোগ্য জ্বালানি: সৌর, বায়ু, জলবিদ্যুৎ এবং বায়োগ্যাসের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং নীতিগত সহায়তা প্রদান করতে হবে।
কয়লার ব্যবহার: পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কয়লা অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি:
গ্যাস আমদানি বহুমুখীকরণ: এলএনজি আমদানির উৎস বহুমুখী করা এবং দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করা।
পাইপলাইন সংযোগ: প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে গ্যাস পাইপলাইন সংযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা এবং এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করা।
গ্যাস মূল্য নির্ধারণে যৌক্তিকতা:
বাজারভিত্তিক মূল্য: গ্যাস ব্যবহারের বিভিন্ন স্তরে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে অপচয় রোধ এবং বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ সৃষ্টি করা যেতে পারে। তবে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস খাত এক গভীর ও বহুমাত্রিক সংকটের আবর্তে নিপতিত। এই সংকট দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি বড় হুমকি। জরুরি ভিত্তিতে একটি সমন্বিত, দীর্ঘমেয়াদী এবং কার্যকর কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। নতুন অনুসন্ধানে জোর দেওয়া, বিদ্যমান সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা, বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং একটি শক্তিশালী নীতি কাঠামো তৈরি করার মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে। সময়োপযোগী এবং সাহসী পদক্ষেপের অভাবে এই সংকট আরও গভীর হতে পারে, যার ফলস্বরূপ দেশের অর্থনীতি এবং জনজীবনে নেমে আসতে পারে এক দীর্ঘমেয়াদী অনিশ্চয়তা। ●
অকা/জ্বা/সকাল/ ১১ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 month আগে