অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সব ধরনের সঞ্চয়পত্র স্কিমের জন্য দুই ধাপে এই হার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ১ জুলাই ২০২৫ থেকে কার্যকর হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ট্রেজারি ও ঋণ ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)-কে প্রজ্ঞাপন জারির অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নতুন হার অনুযায়ী, প্রথম ধাপে—অর্থাৎ ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার নিচে বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার ১২.৫৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১.৮২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে, অর্থাৎ সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য হার ১২.৩৭ শতাংশ থেকে কমে ১১.৭৭ শতাংশ হয়েছে। জানুয়ারি ২০২৫-এ যেখানে সুদহার বাড়ানো হয়েছিল, এবার অর্থবছরের শেষ দিনে এসে সেই হারই আবার হ্রাস করা হলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে গৃহীত ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের শর্ত অনুযায়ী, সরকারকে অভ্যন্তরীণ উৎস—বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নির্ভরতা কমাতে হবে। সেই সাথে, সুদহার বাজারভিত্তিক করতে হবে। এই বাজারভিত্তিক হার নির্ধারণে এখন সরকারি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহারের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট মার্জিন যোগ করে সঞ্চয়পত্রের হার নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে ট্রেজারি বিলের হার কমলে সঞ্চয়পত্রের হারও কমবে।
বর্তমানে চালু ৯টি সঞ্চয় স্কিমের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং ডাকঘর ফিক্সড ডিপোজিট স্কিমে সুদহার কমানোর প্রস্তাব চূড়ান্তভাবে অনুমোদন পেয়েছে।
বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে প্রথম ধাপের বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদহার ১২.৪০ শতাংশ থেকে কমে ১১.৮৩ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ধাপে ১২.৩৭ শতাংশ থেকে ১১.৮০ শতাংশে নেমেছে। প্রথম বছরেই যেখানে আগে সুদ মিলতো ১০.১৩ শতাংশ হারে, এখন তা কমে দাঁড়াবে ৯.৭৪ শতাংশে।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে প্রথম ধাপে সুদহার ১২.৩০ শতাংশ থেকে কমে ১১.৮২ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ধাপে ১২.২৫ শতাংশ থেকে ১১.৭৭ শতাংশ হয়েছে। এই স্কিমে প্রথম বছরে আগে যেখানে সুদ মিলতো ১১.০৪ শতাংশ হারে, নতুন হারে তা হবে ১০.৬৫ শতাংশ।
পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমে প্রথম ধাপে ১১.৯৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ধাপে ১১.৮০ শতাংশে নেমেছে, যেখানে আগে ছিল যথাক্রমে ১২.৫৫ ও ১২.৩৭ শতাংশ। প্রথম বছরের সুদহারে এ স্কিমে ১০.২৩ শতাংশ থেকে কমে তা দাঁড়াবে ৯.৮৪ শতাংশে।
পরিবার সঞ্চয়পত্রের হার প্রথম ধাপে ১২.৫০ থেকে কমে ১১.৯৩ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ধাপে ১২.৩৭ থেকে কমে ১১.৮০ শতাংশ হয়েছে। ডাকঘর ফিক্সড ডিপোজিট স্কিমে প্রথম ধাপে হার কমে ১১.৭৭ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ধাপে ১১.৫৭ শতাংশ হয়েছে, যেখানে আগের হার ছিল ১২.২৫ শতাংশ।
নতুন হারে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক ও ডাকঘর ফিক্সড ডিপোজিট স্কিমে। এই দুটি স্কিমে প্রথম বছরেই সুদহার প্রায় ০.৪০ শতাংশ কমে গেছে।
সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ মনে করেন, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কমিয়ে ব্যাংক নির্ভরতা বাড়ানো বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণের সংকট তৈরি হয়। তার মতে, সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত সঞ্চয় প্রবণতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং মানুষ ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের দিকেই ঝুঁকবে, যেখানে বর্তমানে ১২ থেকে ১২.৫০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ মিলছে।
তিনি আরও বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো মুদ্রানীতি ও সংকোচনমূলক বাজেটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাজেটে ব্যয় সংকোচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, সঞ্চয়পত্রের মতো একটি স্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ ঋণের উৎসকে নিরুৎসাহিত করা অযৌক্তিক। এতে সরকার আরও বেশি ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
এদিকে, জানুয়ারিতে সুদহার বাড়ানোর পর সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করেছিল। মূল্যস্ফীতির চাপে নতুন বিনিয়োগ কমলেও, পুরনো সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর হার হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু এখন সুদহার কমানোয় সেই ইতিবাচক ধারা আবার ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে মানুষের সঞ্চয় করার সক্ষমতা কমে গেছে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগ আরও হ্রাস পেতে পারে। এর ফলে সরকারও অভ্যন্তরীণ ঋণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস থেকে কাঙ্ক্ষিত অর্থ পাবে না। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে