অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের তীব্র সমালোচনার মুখেও আসন্ন বাজেটে কোম্পানির টার্নওভারে বাধ্যতামূলক ন্যূনতম কর হার ০.৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একই সঙ্গে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের ক্ষেত্রেও এই হার চারগুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে আভাস মিলেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনে দুটি মূল কারণ রয়েছে—রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের সক্ষমতার ঘাটতি এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর চাপ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আইএমএফ বারবার বলছে—রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। অথচ কর ফাঁকি ব্যাপক হারে হচ্ছে। অনেক কোম্পানিই প্রকৃত লেনদেন ও মুনাফা গোপন করে। এই অবস্থায় ন্যূনতম কর হার বাড়ানো ছাড়া এনবিআরের সামনে বিকল্প খুব সীমিত।”
তিনি আরও জানান, বার্ষিক ৩ কোটি টাকার বেশি লেনদেনকারী ব্যক্তি করদাতাদের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান ০.২৫ শতাংশ হার বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা হতে পারে। তবে খসড়া বাজেটে একটি স্বস্তির জায়গা হিসেবে ন্যূনতম কর সমন্বয়ের সুযোগ রাখার কথা ভাবা হচ্ছে, যার ফলে এই কর পরবর্তী বছরগুলোতে আয়কর হিসেবে সমন্বয় করা যাবে।
বর্তমানে সরকার কোম্পানি ও ব্যক্তি শ্রেণির টার্নওভারে ন্যূনতম কর থেকে বছরে প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। এনবিআরের হিসাব, প্রস্তাবিত হার কার্যকর হলে বাড়তি আরও প্রায় ৩,৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহ সম্ভব হবে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, এই বাড়তি চাপ কার ওপর পড়বে?
২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত ২ লাখ ৮৮ হাজার কোম্পানির মধ্যে মাত্র ২৪ হাজার ৩৮১টি কর রিটার্ন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে কর ফাঁকি বা লোকসানের অজুহাতে প্রকৃত মুনাফার ওপর কর না দিয়ে ০.৬ শতাংশ হারে ন্যূনতম কর দিয়েছে প্রায় ২৪ হাজার কোম্পানি। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বা প্রায় ৮ হাজার কোম্পানি এই কর নিয়মিত পরিশোধ করে থাকে। অর্থাৎ, প্রস্তাবিত কর হার কার্যকর হলে মূল চাপটি এই সৎ ও নিয়মিত করদাতা কোম্পানিগুলোর ওপরই গিয়ে পড়বে।
এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, লোকসানি বা কম মুনাফার প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে বাধ্য করাটা করনীতির মৌলিক নীতির পরিপন্থী। ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই)-এর সভাপতি মোহাম্মদ জাভেদ আখতার বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম এনবিআর ধাপে ধাপে এই কর তুলে দেবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তা আরও বাড়ানো হচ্ছে, যা সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের জন্য বড় আঘাত।”
তিনি আরও বলেন, “এসএমই এবং নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য এই নীতি অত্যন্ত নিরুৎসাহমূলক। এতে compliant ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি করভার বহন করতে বাধ্য হবে, যা দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে।”
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এফআইসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি রূপালী চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে একটি কোম্পানি গড়ে ব্রেক-ইভেন পয়েন্টে পৌঁছাতে পাঁচ বছর সময় নেয়। সেই সময়ে কোম্পানিকে টার্নওভারের ভিত্তিতে কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা করনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
সাবেক এনবিআর সদস্য (আয়কর নীতি) ও রাজস্ব সংস্কার কমিটির সদস্য আমিনুর রহমান মনে করেন, মুনাফা না হলেও শুধুমাত্র টার্নওভারের ভিত্তিতে কর আদায় করনীতির মূল নীতির পরিপন্থী। তিনি বলেন, “আমরা যে রাজস্ব সংস্কার প্রতিবেদন তৈরি করছি, সেখানে এই ন্যূনতম কর ব্যবস্থাটি বাতিলের সুপারিশ থাকবে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও এ ধরনের কর কাঠামোকে নিরুৎসাহিত করা হয়, কারণ এটি বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।”
প্রকৃত পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হয় একটি বাস্তব উদাহরণে। ধরা যাক, একটি কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার ১০০ কোটি টাকা। বর্তমানে ০.৬ শতাংশ হারে ন্যূনতম কর ধরলে কর দাঁড়ায় ৬৬ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানিটির প্রকৃত মুনাফা ধরলে (২৭.৫ শতাংশ কর হারে) কর হতে পারে ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ, তাকে অতিরিক্ত ১৬ লাখ টাকা কর দিতে হচ্ছে। আর যদি ন্যূনতম কর ১ শতাংশ করা হয়, তাহলে তাকে ১ কোটি টাকা দিতে হবে—যার মানে প্রকৃত আয় বিবেচনায় করহার দাঁড়াবে ৫৫ শতাংশ। কোম্পানিটি যদি লোকসানে থাকে, তাহলে পুরো অর্থটাই দিতে হবে মূলধন থেকে।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম স্নেহাশীষ মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির পার্টনার স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, “যেসব কোম্পানি নিরীক্ষিত বিবরণীতে প্রকৃত টার্নওভার দেখায়, তাদের ওপরই এই করের চাপ পড়ে। শুধু তাই নয়, সরবরাহকারীরাও এটি খরচ হিসেবে ধরলে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যা ভোক্তা পর্যায়েও প্রভাব ফেলবে।”
অন্যদিকে, চৌধুরী এমদাদ অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজিং পার্টনার এস কে জামি চৌধুরী জানান, “আমরা প্রতিবছর প্রায় ১৫০টি কোম্পানির অডিট করি, যার মধ্যে অন্তত ১৫ শতাংশ কোম্পানি প্রকৃতপক্ষে লোকসানে থেকেও ন্যূনতম কর দিতে বাধ্য হয়। কর হার বাড়লে এই কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ আরও বেড়ে যাবে।”
তবে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, “অনেক কোম্পানি কর ফাঁকি দিতে মুনাফা গোপন করে। যদি ন্যূনতম কর না রাখা হয়, তাহলে এসব কোম্পানি থেকে এক টাকাও রাজস্ব আসবে না। সেজন্যই এই ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে।”
তবে আমিনুর রহমান তার পাল্টা যুক্তিতে বলেন, “সৎ কোম্পানিকে শাস্তি দিয়ে অসৎদের ফাঁকি পুষিয়ে নেওয়া কোনো অর্থেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এটা মাথাব্যথায় মাথা কেটে ফেলার মতো সিদ্ধান্ত।” ●
অকা/রাখা/সকাল/ ১৩ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 month আগে