অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
এক সময় যেটি আর্থিকভাবে ‘বিচক্ষণ’ সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হয়েছিল, সেটিই এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক নীরব বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজার-ভিত্তিক উচ্চ সুদ এড়াতে বাংলাদেশ সরকারের জাপানি ইয়েনে ঋণ গ্রহণের কৌশল এখন ধীরে ধীরে ব্যুমেরাং হয়ে উঠছে— যার প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যে দেখা যাচ্ছে বাজেট সহায়তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্পে।
বিশ্বব্যাপী ডলার ঋণের সুদহার যখন উর্ধ্বমুখী, তখন বাংলাদেশের জন্য ইয়েন ছিল তুলনামূলক ‘সস্তা’ ঋণের উৎস। কিন্তু মুদ্রার বিনিময় হারের ঝুঁকি এবং সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের সুদহার বৃদ্ধির সম্ভাবনা এই কৌশলের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ—এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (ADB) ৬০০ মিলিয়ন ডলার সমমূল্যের বাজেট সহায়তা ঋণ, যা সম্পূর্ণভাবে ইয়েনে নেওয়া হয়েছিল। এই অর্থ ডলারে রূপান্তর করার সময় বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৩ মিলিয়ন ডলার— শুধুমাত্র ইয়েনের দরপতন এবং বিনিময় হারের কারণে। এছাড়াও গত বছর এডিবি ও এআইআইবির বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে আরও প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ইয়েন ঋণ নেওয়া হয়েছে, যার ঝুঁকি এখনো কার্যকরভাবে বিশ্লেষণ বা মূল্যায়ন করা হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্পে নেওয়া ২৮০ মিলিয়ন ডলারের অর্ধেকই নেওয়া হয়েছিল ইয়েনে—যার উদ্দেশ্য ছিল ডলারের সুদহার থেকে মুক্ত থাকা। তবে প্রকল্পটি বাণিজ্যিক রাজস্ব তৈরি না করায়, চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতি বছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা পরিশোধের চাপে পড়ছে। এর ফলে সরকারকেই এখন হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে। চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা বলেছেন, বৈদেশিক ঋণ গ্রহণে প্রকল্প সংস্থা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না— তা নির্ধারণ করে অর্থ বিভাগ, ইআরডি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ফলে ঝুঁকির দায়ও সরাসরি তাদের ওপর পড়ে না, অথচ ক্ষতির বোঝা বহন করতে হচ্ছে তাদেরই।
বর্তমানে বাংলাদেশের ইয়েনভিত্তিক বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার, যা চার বছর আগে ছিল ৭.৫২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, মাত্র কয়েক বছরে এই ঋণের পরিমাণ ৬০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (SOFR) ৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে, ফলে ডলার ঋণ এখন ব্যয়বহুল হলেও ইয়েন ঋণও এখন আর ততটা ‘সাশ্রয়ী’ নেই।
অর্থ বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, “বিশ্বব্যাপী ডলার ঋণের খরচ যখন বাড়ে, তখন ইয়েনকে বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে রিজার্ভ যখন প্রধানত ডলারভিত্তিক, তখন ইয়েন-ভিত্তিক ঋণ রূপান্তরের সময় বিশাল ক্ষতির ঝুঁকি থাকে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরিও সতর্ক করে বলেন, “যে দেশে ডলারই প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা, সেখানে ইয়েন বা ইউয়ানভিত্তিক ঋণ গ্রহণ মানে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঝুঁকি নেওয়া। কারণ বৈশ্বিক রিজার্ভ হিসেবে ডলারের গ্রহণযোগ্যতা এখনও শীর্ষে।” বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ১৮% ইয়েনে, ৩৭% ডলারে এবং ৩৬% বিশেষ ড্রয়িং রাইটসে (SDR) রয়েছে।
ঋণ পরিশোধের সময় আসলে যদি সরকারের নিজস্ব আয় বা রিজার্ভ না থাকে, তাহলে এসব দেনা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, এমনকি ব্যাংকিং খাত ও মুদ্রানীতি—সবকিছুর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত এমন ঋণ যখন অব্যবস্থাপনা বা বাণিজ্যিকভাবে অকার্যকর প্রকল্পে ব্যয় হয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, এখন সময় এসেছে বাজার-ভিত্তিক ঋণ নীতির একটি স্বচ্ছ, বাস্তবভিত্তিক এবং দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো তৈরি করার। বিশেষ করে, কোন মুদ্রায়, কোন প্রকল্পে, কোন শর্তে ঋণ নেওয়া হবে—এসব বিষয়ে আগে থেকেই ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও পরিকল্পনা ছাড়া ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
যা একসময় ‘সাশ্রয়ী’ এবং ‘চতুর’ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল, আজ সেটিই বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক বিপজ্জনক বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন সময় নীতিগত পরিবর্তন, রিজার্ভ কাঠামোর বৈচিত্র্য এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার দিকে আরও গুরুত্ব দেওয়ার। ●
অকা/ব্যাংখা/সকাল/ ৬ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে