অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক—এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক—গভীর সংকটে পড়েছে। এসব ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতির পাশাপাশি এই ব্যাংকগুলোর বড় অংশের ঋণ খেলাপি হয়েছে এবং আমানত-সম্পদের মধ্যে বিপজ্জনক ব্যবধান তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, এই বিপুল সংকট থেকে উত্তরণে একমাত্র সমাধান হতে পারে একীভূকরণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে সরকারকে অনুরোধ করেছে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা সরবরাহের জন্য, যা আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ধাপে ধাপে মূলধন হিসেবে দেওয়া হতে পারে। অবশিষ্ট অর্থ স্পন্সর পরিচালকদের জব্দকৃত শেয়ার বিক্রি করে সংগ্রহ করা হবে। যেসব শেয়ার বিক্রি সম্ভব হবে না, তা স্থানীয় নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছে ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, এত বড় ঘাটতি নিয়ে ব্যাংকগুলো পরিচালনা সম্ভব নয়, তাই একীভূকরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এই প্রক্রিয়ায় শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের চাকরি টিকে থাকবে না বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি, যদিও নিম্নপর্যায়ের কর্মীদের চাকরি সুরক্ষিত থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
সংকটের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে ব্যাপক পরিমাণ ঋণ খেলাপি ও এস আলম গ্রুপের প্রভাব। পাঁচটির মধ্যে চারটি ব্যাংক—এসআইবিএল, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক—পূর্বে এস আলম গ্রুপের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে এসব ব্যাংকের স্পন্সর পরিচালকদের মালিকানাধীন শেয়ার জব্দ করেছে।
ব্যাংকগুলোর সম্পদ ও দায় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ফার্স্ট সিকিউরিটির খেলাপি ঋণের হার ৯৫ শতাংশ, একই হারে খেলাপি ঋণ রয়েছে ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে। এসআইবিএলের খেলাপি ঋণের হার ৬০ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ২৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এদের সম্মিলিত সম্পদ-দায় ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৩১৬ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই পাঁচ ব্যাংকে মোট আমানত ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু ঋণ বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা, ফলে ৫৫ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবধান তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে একীভূকরণের যৌক্তিকতা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের ভিন্নমত রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন প্রশ্ন তুলেছেন, এক্সিম ও এসআইবিএলের মতো তুলনামূলক স্থিতিশীল ব্যাংককে কেন জোর করে একীভূত করা হচ্ছে? তাঁর মতে, প্রতিটি ব্যাংকের কাছ থেকে তাদের নিজস্ব রেজল্যুশন প্ল্যান চেয়ে তার কার্যকারিতা বিচার করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
অন্যদিকে, সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বাংলাদেশে অতিরিক্ত ব্যাংকের উপস্থিতি এবং এসব ব্যাংকের ভয়াবহ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে একীভূকরণ একটি যৌক্তিক পদক্ষেপ। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, নতুন সত্ত্বার টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি টেকসই মডেল তৈরি করতে হবে এবং খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাযথ প্রভিশন সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৫ সালের ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স অনুসারে ‘ব্রিজ ব্যাংক’ গঠনের সম্ভাবনা বিবেচনা করছে। এই কাঠামোর অধীনে সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোকে অস্থায়ীভাবে সরকারি মালিকানায় এনে পুনর্গঠনের পর তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করার সুযোগ থাকবে। ব্রিজ ব্যাংকের অধীনে মূল ব্যাংকের সম্পদ, দায় ও আইনি অধিকার হস্তান্তর করে একটি কার্যকর রেজল্যুশন প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে।
ব্রিজ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেবে। সাধারণত এর মেয়াদ হবে দুই বছর, তবে প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। ব্রিজ ব্যাংক গঠনের পর মূল ব্যাংকের লাইসেন্স বাতিল করা হবে এবং অবশিষ্ট দায়সমূহ অবসায়নের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে।
এই পুরো প্রক্রিয়া সফল করতে হলে শুধু মূলধন সরবরাহ নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন, এবং সময়োপযোগী নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য। অন্যথায়, একীভূকরণ প্রক্রিয়া ব্যাংকিং খাতকে রক্ষার চেয়ে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিতে পারে। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৩ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে