প্রণব মজুমদার ●
গ্রাম কিংবা শহরের রাস্তাঘাট, সেতুসহ অবকাঠামোগত অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে গত ১০ বছরে। কিন্তু কমেনি সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা। গত আট বছরের হিসেবে দেখা যায় ২০২২ সালে দেশে সর্বোচ্চ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ দাবি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির। সমিতির দুর্ঘটনা তদারকি সেলের বার্ষিক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে ৬৭৪৯টি দুর্ঘটনায় ৯৯৫১ জন নিহত এবং ১২৩৫৬ জন আহত হয়েছে। এ সংখ্যার মধ্যে সড়ক, রেল ও নৌ পথের দুর্ঘটনা যুক্ত।
প্রতিবেদন অনুযায়ী নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্ঘটনার মধ্যে মোটর সাইকেল ও ইজিবাইকে নিহত ও আহতের সংখ্যা বেশি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) পরিচলিত কার্যক্রমের এক অনুষ্ঠানে গত বছর এআরআই’র অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার সড়ক দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতির পরিসংখ্যানগত উপাত্ত দেন। তিনি জানান, দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বার্ষিক ক্ষতি ৭০ হাজার কোটি টাকা যা আমাদের জিডিপির ২ শতাংশ। তাঁর মতে, রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয় যা জিডিপির ৩ শতাংশ।
সড়ক দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে, বা আহত হলে একটা পরিবারের ওপর দিয়ে কতটা বিপর্যয় নেমে আসে, সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। উন্নত অনেক দেশেই বীমার ব্যবস্থা আছে। অথচ বাজারের তুলনায় সংখ্যাধিক্য জীবন বীমা কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে সরাসরি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই।
২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ‘সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ বিধিমালা’ প্রকাশ করে সরকার। বিধিমালা অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির যদি চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে তাকে এককালীন তিন লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। আর যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে তাহলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে এক লাখ টাকা।
সন্দেহ নেই, নিয়মটি ভালো। আগে যেখানে এক টাকাও কেউ পেত না, আর দাবি করলেও ২০ হাজার টাকার বেশি পাওয়ার কোনও সুযোগই ছিল না, সেখানে তিন লাখ বা এক লাখের অংকটা অবশ্যই মন্দ নয়। এ তো গেলো আহতের জন্য ক্ষতিপূরণ। আর মারা গেলে? নিহতের জন্য ক্ষতিপূরণের অংকটা রাখা হয়েছে পাঁচ লাখ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, টাকাটা আসবে কোথা থেকে? কে দেবে? কীভাবে দেবে? বিধিমালায় সে বিষয়গুলোও স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য একটা তহবিল করা হবে।
এছাড়া বিধিমালায় তহবিল গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কেও বলা আছে। এই তহবিলে মোটরযান মালিক প্রতিটি মোটরযানে বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে বার্ষিক বা এককালীন চাঁদা দেবে। এ তহবিল গঠনে মোটর সাইকেলের মালিককে এককালীন ১ হাজার টাকা দিতে হবে। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইম মুভারের জন্য বার্ষিক দেড় হাজার টাকা দিতে হবে। মিনিবাস, মিনি ট্রাক ও পিকআপের জন্য বার্ষিক ৭৫০ টাকা ধার্য হয়েছে। কার, জিপ ও মাইক্রোবাসের জন্য বার্ষিক ৫০০ টাকা দিতে হবে। আর থ্রি-হুইলার ও অন্যদের বার্ষিক ৩০০ টাকা দিতে হবে। মোটর সাইকেল ছাড়া অন্যান্য যানের চাঁদা দেওয়ার নির্দিষ্ট মেয়াদ চলে গেলে প্রতি মাস বা মাসের অংশবিশেষের জন্য ৫০ টাকা হারে অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হবে।
২০২৩ সাল শুরু থেকে এই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের কর্মকাণ্ড চালু হয়ে গেছে। বেশ কিছু আবেদন জমা পড়ে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১০টি আবেদনপত্র জমা পড়ে। সেগুলো থেকে ৬৩টির অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এর মধ্যে নিহত ৩৮ জনের পরিবার ও আহত ২৫ জন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য বলে প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছে। অক্টোবর মাসের ২২ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের কাছে সেই ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করা হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা এবং যানজট আমাদের নাগরিক জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ১৯৯৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে। আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে সড়কে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। আর পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ১০ শতাংশ।
এআরআইয়ের গবেষক ও বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, প্রকৌশলগত ত্রুটি ও সচেতনতার অভাবে পথচারীরা মারা যাচ্ছেন। সব স্থানে জেব্রা ক্রসিং না থাকা, ফুটপাত না থাকা কিংবা অবৈধ দখলে চলে যাওয়া, স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, পথচারী পারাপারে অব্যবস্থাপনা অন্যতম প্রকৌশলগত ত্রুটি দেশের সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তিনি বলেন, যেখানে সেখানে গতিরোধক করা মানেই যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। এতে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। গবেষণা বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। এআরআইয়ের গবেষণা অনুসারে, দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া লোকজনের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত লোকদের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু, এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
বিশ্বের নামকরা চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির এই হিসাব দিয়েছেন। ১৬৬টি দেশের দুর্ঘটনাজনিত ব্যয়ের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তারা এই হিসাব বের করেছেন। ২০১০ সালকে ভিত্তি ধরে তারা হিসাবটি কষেছেন। তারা ২০১৫ থেকে ২০৩০ সালের প্রাক্কলন দিয়ে বলেছেন, এই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাংলাদেশে ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। প্রতিষ্ঠান চারটি হচ্ছে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইডেলবার্গ ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ, মোহেনহেইম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিকস, অস্ট্রিয়ার ভিয়েন ইনস্টিটিউট অব ডেমোগ্রাফি এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড টি এইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড পপুলেশন বিভাগ। গবেষকেরা বলছেন, প্রতি বছর সারা বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতি বৈশ্বিক জিডিপির দশমিক ১২ শতাংশ। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয় স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় বোঝা সড়ক দুর্ঘটনা। গবেষণা ফলাফল সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতায় তিন হাজার ৯৪৩ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, চার হাজার ৮৮২ দশমিক ৯৪ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১৩ হাজার ৫৫৬ দশমিক ২০ কিলোমিটার জেলা মহাসড়ক রয়েছে। সব মিলিয়ে ২১ হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়ক মহাসড়কের সবখানেই কমবেশি রয়েছে গতিরোধক।
মহানগরে পথচারী পারাপারের জন্য যে জেব্রা ক্রসিং তা রিকশাসহ যানবাহনগুলো আটকে রাখে। পথচারী রাস্তা পার হতে পারে না। রাস্তার বাম দিকও পরিবহনগুলো আটকে রাখে। আনসার সদস্য কি আর সড়ক আইন জানে? তাকে কে মানে? এছাড়া ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, সড়কের পাশে হাটবাজার বসা, চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের অভাব ইত্যাদি কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি বেঁধে দিয়ে এবং গতি পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করে চালকদের ওই নির্দিষ্ট গতি মেনে চলতে বাধ্য করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে বলে মনে করি।
তাছাড়া চালকদের দক্ষতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে। মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজটি করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী। অনেক পরিবহণ মালিক চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেন না। ক্লান্ত চালক গাড়ি চালালে স্বভাবতই তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি তো বেড়ে যাবেই!
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের পরামর্শ ও সুপারিশ প্রদান করা হলেও তা যে অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হচ্ছে, দেশে প্রতিদিন সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোই এর বড় প্রমাণ। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইনের প্রয়োগ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চালক প্রয়োজন। সড়ক চলাচলে ফিটনেসবিহীন পরিবহন পরিহার করা জরুরি। ●
অকা/নদ/নিলে/সকাল/২৬ আগস্ট, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
লেখক কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক
reporterpranab@gmail.com
সর্বশেষ হালনাগাদ 8 months আগে