অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশ বর্তমানে এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, যার মূল কারণ মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার অব্যাহত অবমূল্যায়ন। এই পরিস্থিতি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ব্যয়কে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলস্বরূপ সরকার এখন মূলধন ও সুদ পরিশোধে বিশাল চাপের সম্মুখীন। অর্থ বিভাগের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতিসংক্রান্ত প্রতিবেদনে এই উদ্বেগের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যেখানে ঋণের ঝুঁকি সম্পর্কে গুরুতর সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদনটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেছে।
টাকার মূল্য হ্রাসের ফলে একই পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ করতে সরকারকে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশেষ করে, বর্তমানে মোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় ৫৩ শতাংশ মার্কিন ডলারে নেওয়া হয়েছে, যা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলেছে। এছাড়াও, জাপানি ইয়েনে ২২ শতাংশ, চীনের ইউয়ানে ৭ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৪ শতাংশ অন্যান্য মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী, পুরোনো ঋণের মেয়াদপূর্তি এবং কিছু ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে আগামী বছরগুলোতে ঋণ পরিশোধের ব্যয় আরও বাড়বে, যা অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল পরিশোধে ২৬১ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছে, যা ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৩৩৪ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। শুধু তাই নয়, আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) শুধু সুদ পরিশোধের জন্য ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এবং ২২ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে। এই বিশাল অঙ্কের সুদ পরিশোধের বোঝা সরকারের আর্থিক সক্ষমতার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।
সরকারের মোট ঋণের দায় (২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত) ১৯ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি উদ্বেগজনক চিত্র। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যাংক ঋণ ৬ লাখ ৮২ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২৬ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ ধারণা করছে, চলতি অর্থবছর (২০২৪-২৫) শেষে এই ঋণ সাড়ে ১৯ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে এবং নতুন অর্থবছরে (২০২৫-২৬) তা প্রায় ২২ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। এই ক্রমবর্ধমান ঋণনির্ভরতা দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি এই পরিস্থিতির বিষয়ে তার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান যে, রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় সরকারের ঋণ নির্ভরতা ক্রমাগত বাড়ছে। তার মতে, অত্যাবশ্যকীয় ও উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে, কিন্তু এই ঋণ পরিশোধের বিষয়টি মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি না করে যদি ঋণনির্ভরতা বাড়তে থাকে, তবে এমন এক সময় আসবে যখন ঋণ পরিশোধের চাপ একটি বিশাল আকার ধারণ করবে। তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন যে, দুর্নীতি, অপচয় এবং অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় না করে ঋণের অর্থ উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা সরকারের জন্য অপরিহার্য।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশ তার মোট জিডিপির ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ গ্রহণ করতে পারে, যা ঝুঁকিমুক্ত বলে বিবেচিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণের অনুপাত জিডিপির ৩৭.৬২ শতাংশে পৌঁছেছে এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে তা ৩৭.৭২ শতাংশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও এই অনুপাত বর্তমানে আইএমএফ নির্ধারিত নিরাপদ সীমার মধ্যে রয়েছে, অর্থ বিভাগ সতর্ক করেছে যে, দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক শৃঙ্খলা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এই ক্ষেত্রে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং সময়োপযোগী সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, দেশের ঋণ পরিস্থিতির মধ্যমেয়াদি চিত্র সরকারের গৃহীত কার্যকর কৌশলগুলোর বাস্তবায়নের ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে।
এই অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদি এই পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা না হয়, তবে ঝুঁকির মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তেই থাকবে। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণ না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশ, অর্থনৈতিক সংকট, আস্থার অভাব এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা কারণ বিদ্যমান। এসব কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরছে না এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও স্থবিরতার মুখে পড়ছে। এর প্রভাবে সন্তোষজনক রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না এবং আয় কম হওয়ায় সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে বেশি ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। এই ঋণ ও সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে পুনরায়0 ঋণ নিতে হচ্ছে, যা এক দুষ্টচক্র তৈরি করেছে। সামগ্রিকভাবে, সরকারের ঋণ পরিস্থিতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং রাজস্ব আহরণের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য একটি সমন্বিত ও কার্যকর অর্থনৈতিক কৌশল অপরিহার্য। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/১৭ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 weeks আগে