অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
২০২৪ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নতুন এক ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে, যা কেবল একটি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান নয়—বরং সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত্তিমূলেই কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বছরের শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০.২০ শতাংশ। এই সময়ে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণস্থিতি ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়—প্রায় প্রতি ৫ টাকার মধ্যে ১ টাকা ব্যাংকগুলো আদায় করতে পারছে না। যা কেবল ব্যাংকের আয় নির্ভরযোগ্যতা কমায় না, বরং তাদের মূলধন ভিত্তিকে সরাসরি দুর্বল করে তোলে।
খেলাপি ঋণের চাপ: মূলধনের ওপর সরাসরি আঘাত
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র তিন মাসে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) ২০টি ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকায়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৩ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। এই বিস্ময়কর বৃদ্ধির পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে:
১. খেলাপি ঋণের হঠাৎ প্রবৃদ্ধি,
২. মূলধন গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আয়ের ঘাটতি ও প্রভিশনিংয়ের ঘাটতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকেরই আরেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে ১০টি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ৩৯ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা, যা এক বছরে বেড়ে প্রায় চারগুণে পৌঁছেছে। অর্থাৎ একটি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত দুর্বলতা ক্রমান্বয়ে গভীরতর হয়ে উঠছে।
সিআরএআর পতন: আর্থিক স্থিতিশীলতার সংকেত?
মূলধন ঘাটতির এই পরিস্থিতি দেশের ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত বা সিআরএআর (Capital to Risk-Weighted Asset Ratio) কে ভয়াবহভাবে নিচে নামিয়ে এনেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এই অনুপাত দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশে, যেখানে আগের প্রান্তিকে (সেপ্টেম্বর ২০২৪) এটি ছিল ৬.৮৬ শতাংশ। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী এই অনুপাত কমপক্ষে ১০ শতাংশ থাকা বাধ্যতামূলক। এই অনুপাত মূলত একটি ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের তুলনায় তার মূলধনের পরিমাণকে নির্দেশ করে। নিম্ন সিআরএআর মানে, ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বেশি দিচ্ছে, অথচ সেগুলোর বিপরীতে যথেষ্ট মূলধন সংরক্ষণ করছে না—যা ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের সংকট ডেকে আনতে পারে।
ব্যাসেল-৩ ও বাস্তবতার ফারাক
ব্যাসেল-৩ নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংককে ন্যূনতম ১০ শতাংশ অথবা ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সেই পরিমাণ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। এই শর্ত পূরণ না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে মূলধন ঘাটতির আওতায় গণ্য করা হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী, এমন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকগুলো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারে না। এর ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায় এবং বাজারে তাদের শেয়ারের দরও নিম্নমুখী হয়।
কাঠামোগত দুর্বলতা না কি নীতিনির্ধারণী ব্যর্থতা?
বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে—এই ঘাটতি কি কেবল অর্থনৈতিক প্রভাবের ফল, নাকি নীতিগত উদাসীনতার প্রতিফলন? ব্যাংকগুলোর অনেক ক্ষেত্রেই ঝুঁকিপূর্ণ খাত যেমন—রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, রাজনৈতিক প্রভাবাধীন ঋণ বিতরণ এবং দুর্বল প্রভিশনিং ব্যবস্থাপনা—খেলাপি ঋণ বাড়ার অন্যতম কারণ। তদুপরি, নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে তদারকি ও নজরদারির ঘাটতিও সমস্যাটিকে দীর্ঘায়িত করেছে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে একটি ত্রিমাত্রিক সংকটে রয়েছে—খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি, মূলধন ঘাটতির বিস্তার এবং সিআরএআর-এর ধস। যদি এই সংকটকে সময়মতো যথাযথ নীতিমালার মাধ্যমে মোকাবিলা না করা হয়, তাহলে ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও বিনিয়োগ পরিবেশে। ●
অকা/ব্যাংখা/সকাল/ ৬ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে