অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, ব্যাংক খাতের গভীর তারল্য সংকট এবং ব্যবসায়ীদের আস্থার অভাবের ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে উদ্বেগজনক স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মে ২০২৫ পর্যন্ত প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৯৫ শতাংশ, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৯.৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। অথচ এক বছর আগেও এই হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি।
বিগত কয়েক মাস ধরেই ঋণ প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। এপ্রিল ২০২৫-এ এই হার ছিল ৭.৫০ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৬.৮২ শতাংশ, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে জানুয়ারিতে ৭.১৫ শতাংশ, ডিসেম্বরে ৭.২৮ শতাংশ, নভেম্বরে ৭.৬৬ শতাংশ, অক্টোবরে ৮.৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৯.২ শতাংশ, আগস্টে ৯.৮৬ শতাংশ এবং জুলাই ও জুনে ১০ শতাংশের কিছু বেশি ছিল এই হার। এই নিম্নমুখী প্রবণতা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে, দেশে বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞ ও ব্যাংকারদের মতে, ২০২৪ সালের আগস্টে সরকারের পতন এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত প্রশাসনিক ক্ষমতার কারণে বিনিয়োগ পরিবেশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না, ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও কমে গেছে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ জানান, “বেসরকারি খাতে ঋণ তখনই বাড়বে, যখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে আস্থা তৈরি হবে। অনিশ্চয়তা থাকলে কেউই নতুন করে বিনিয়োগে যায় না।” তিনি বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার উন্নতি না হওয়ায় বিনিয়োগের পরিবেশ আরও প্রতিকূল হয়ে উঠেছে।
ব্যাংকিং খাতের নিজস্ব সংকটও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণের বোঝা বহন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ। এর ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরও তীব্র হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর নতুন ঋণ বিতরণ ব্যাহত হচ্ছে এবং পুঁজির ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম, কারণ উদ্যোক্তারা অনিশ্চয়তা এবং রাজনৈতিক ঝুঁকি বিবেচনায় নতুন বিনিয়োগে যেতে চাইছেন না।” তিনি আরও বলেন, “ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তারল্য সংকট রয়েছে এবং সরকারও প্রচুর পরিমাণে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। সরকারকে ঋণ দেওয়া অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হওয়ায় অনেক ব্যাংক বেসরকারি খাতের বদলে সরকারি বন্ড ও বিল-এ বিনিয়োগ করছে।”
তিনি উল্লেখ করেন, “আমদানি বাড়ানো এবং বিশেষ করে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি বাড়াতে পারলে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং তারল্যও বাড়বে, যা ঋণ প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ২.৯৮ শতাংশ বেড়েছে, নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ৬.০৮ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে মোট এলসি খোলা হয়েছে ৫৮.৯৪ বিলিয়ন ডলারের, এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৮.৮২ বিলিয়ন ডলারের। তবে বিপরীতে, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিতে বড় ধস নেমেছে—এলসি খোলা ২৭.৪৬ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি ২৫.৫৬ শতাংশ কমেছে। এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতে উদ্যোক্তারা অনাগ্রহী।
সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, “মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের সঞ্চয় কমছে, এর সঙ্গে খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরও বাড়বে। এতে ব্যবসার জন্য অর্থায়ন পাওয়া কঠিন হবে।” তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অনেক শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন কমে গেলে বাজার চাহিদাও কমে যায় এবং তার ফলে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা কমে যাওয়ায় খেলাপির ঝুঁকি বাড়ছে।”
সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন জানান, “ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বেড়ে যাওয়ায় তাদের ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমেছে। এতে ব্যবসা সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং কর্মসংস্থান তৈরি নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।” তিনি বলেন, “বর্তমানে ব্যবসায়ীরা উচ্চ উৎপাদন ব্যয় এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার চাপে বিনিয়োগ থেকে দূরে থাকছেন, ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।”
তবে আশাবাদী অনেকে বলছেন, সম্প্রতি নতুন বাজেট পেশ, কিছুটা আইনশৃঙ্খলার উন্নতি এবং আমদানি-রপ্তানিতে ধীরে ধীরে ইতিবাচক গতি ফেরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করছেন, আগামী কয়েক মাসে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে এবং উৎপাদন-ভিত্তিক খাতে চাহিদা বাড়লে বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধিও ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে সে জন্য দরকার বাস্তবভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, তারল্য ব্যবস্থাপনায় নীতিগত সহায়তা এবং দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/২ জুলাই, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 week আগে