অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
খাবার, হালকা ইস্পাত, ইলেকট্রনিক্স, হোম অ্যাপ্লায়েন্স থেকে শুরু করে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন—সব খাতেই বিজ্ঞাপন ও বিপণন ব্যয় কমানো এখন অভিন্ন প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক চাপ মোকাবিলায় অনেক প্রতিষ্ঠানই ইউটিলিটি ব্যবহারে সংযম, অফিস খরচ হ্রাস এবং কর্মী কাঠামো পুনর্বিন্যাসের পথে হাঁটছে। কেউ কেউ প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়ে খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প উৎসে অর্থায়নের পথ খুঁজছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
এমন প্রবণতার পেছনে আছে তিনটি বড় চাপ—অব্যাহত মূল্যস্ফীতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং ব্যাংকের উচ্চ সুদহার। সামষ্টিক অর্থনীতির এই ত্রিমুখী চাপে বড় ছোট সব প্রতিষ্ঠানই আয় সংকোচন ও ব্যয় সংকোচনের এক সংকটপূর্ণ চক্রে আটকে পড়ছে।
ইলেকট্রো মার্ট গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল আফসার বলেন, পরিস্থিতি এতটাই কঠিন যে খরচ না কমালে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবে না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা বিপণন কার্যক্রম নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, চলমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে পণ্যের দাম বাড়ালে বিক্রি আরও কমে যাবে—এই আতঙ্কে তারা বরং খরচই কমাচ্ছেন। কয়েক বছর আগেও যেখানে ব্যাংক থেকে ৯-১০ শতাংশ সুদে ঋণ মিলত, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৭-১৮ শতাংশ। ফলে ঋণের খরচ বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ, যা সরাসরি লাভ কমিয়ে দিচ্ছে।
তার ভাষায়, প্রতিটি খরচ এখন বিবেচনায় নিচ্ছেন তারা। ইউটিলিটি বিল, অফিস খরচ, অপ্রয়োজনীয় পদ—সব কিছুর তালিকা তৈরি করে কাটছাঁট চলছে। ব্যবসায়িক পরিবেশ যদি দ্রুত না বদলায়, তাহলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠবে।
বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত জানান, শুধু তাদের প্রতিষ্ঠান নয়, দেশের প্রায় সব শিল্প প্রতিষ্ঠান এখন খরচ কমানোর একই নীতিতে চলছে। মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার—দুইয়ের চাপে তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়াচ্ছেন, যাতে কম কর্মী দিয়ে বেশি আউটপুট পাওয়া যায়। তার ভাষায়, প্রতিটি ব্যয়ের যুক্তিসঙ্গততা যাচাই হচ্ছে। এমনকি প্রচার ও ব্র্যান্ডিং খাতে ব্যয়ও বড় অংশে কমানো হয়েছে।
সুদের উচ্চ হারের প্রভাবে নতুন বিনিয়োগ এখন কার্যত স্থগিত। কারণ, ঋণ নেওয়ার খরচ বর্তমানে এত বেশি যে অনেক প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যৎ আয় দিয়ে সেই ঋণের ভার সামলাতে পারবে না—এমন শঙ্কা থেকেই নতুন প্রকল্প বন্ধ রাখা হচ্ছে।
একই সংকট প্রকাশ করছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী। তার ভাষায়, উচ্চ সুদ ও মুদ্রার মান হ্রাসের যুগল প্রভাব দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলোকেও নাজুক অবস্থায় ফেলেছে। তিনি বলেন, টিকে থাকতে হলে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমাতে হয়েছে। একই সঙ্গে উৎপাদন খরচ ও বিপণন ব্যয়ও পুনর্মূল্যায়নের আওতায় এসেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিকল্প উৎস থেকে অর্থায়ন নিশ্চিত করার চেষ্টায় আছে বলে জানান তিনি।
ব্যবসার পরিবেশে তৈরি হওয়া এই চাপ সবচেয়ে বেশি অনুভব করছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণগ্রহণ এখন এতটাই ব্যয়বহুল যে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য তা প্রায় অচল। ফলে অনেকে পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন, যা ভোক্তাদের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিসিআই সভাপতির মতে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি মুনাফা কমার কথা জানাচ্ছে, সেগুলোর রিপোর্ট দেখে মোটামুটি একটি চিত্র আঁকা গেলেও প্রকৃত সংকট আরও গভীর। কারণ, অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানই তালিকাভুক্ত নয়, এবং তাদের অবস্থান পরিসংখ্যানের বাইরে রয়ে যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকরা বলছেন, নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে এখনই সুদহার নিয়ন্ত্রণ, স্থিতিশীল মুদ্রানীতি এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। না হলে ব্যবসার ওপর একধরনের ‘নীরব মন্দা’ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যার ফলে পণ্য উৎপাদন, কর্মসংস্থান, রপ্তানি আয় ও বিনিয়োগ প্রবাহ—সবই আক্রান্ত হবে।
বর্তমানে ব্যবসায় যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে তা স্থায়ী হলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রতিফলন পড়বে দীর্ঘমেয়াদে। সরকারের জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, আর্থিক খরচ কমিয়ে উদ্যোক্তাদের জন্য আস্থা পুনঃস্থাপন এবং কার্যকর পলিসি সহায়তা নিশ্চিত করা। ●
অকা/প্র/ই/ সকাল/২৫ মে, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 months আগে