অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করায় দেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্পে স্বস্তির বাতাস বইছে। শিল্প সংশ্লিষ্ট ও অর্থনীতিবিদরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতির পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। তবে একইসঙ্গে বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণে সতর্ক ও কৌশলী হওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন তাঁরা।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, "ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি তিন মাসের জন্য সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। ফলে আগের ১৬ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে আরও ১০ শতাংশ ফ্ল্যাট রেটে শুল্ক বহাল হচ্ছে, তবে অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্ক আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।"
চৈতী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল কালাম এ সিদ্ধান্তকে 'বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক পোশাক শিল্পের জন্য ইতিবাচক' বলে মন্তব্য করেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি লিখে শুল্ক স্থগিত করার অনুরোধ জানান, যার ফলেই এই স্থগিতাদেশ এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক হারে শুল্কারোপ করায়, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রফতানির সম্ভাবনা দেখছেন বিজিএমইএ'র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল কার্যাদেশের বড় অংশ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, যা আগে চীন পূরণ করতো। তিনি বলেন, "২০২৪ সালে চীন যুক্তরাষ্ট্রে ১৬.৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। নতুন করে চীনা পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্ক বসানোর ফলে, বাংলাদেশ আরও আকর্ষনীয় বিকল্প উৎস হিসেবে সামনে চলে আসতে পারে।"
চীনের ওপর এই বিপুল শিল্কের কারণে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার এই ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান। এনিয়ে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, "এমন অল্প সময়ে এবং বৈশ্বিক বাজারের অনিশ্চয়তা মাথায় রেখে, বাংলাদেশ খুব একটা বড় সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে বলে মনে হয় না।" তবে তিনি মনে করছেন, রফতানির ওপর তিন মাসের জন্য শুল্ক স্থগিত করা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।
তিনি বলেন, "এই সাময়িক বিরতি আমাদের জন্য কূটনৈতিকভাবে ও বাণিজ্য আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। আপাতত রফতানিকারকদের জন্য এটি কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে, কারণ অর্ডার বাতিল বা স্থগিত হওয়ার ঝুঁকি কমেছে। এতে সরকারি ও বেসরকারিখাতও ভবিষ্যৎ শুল্ক সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় দরকারি প্রস্তিতি নেওয়ার সময় পাবে।"
ড. রায়হান তাঁর ফেসবুক পোস্টে আরও উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ শতাংশ বেজলাইন শুল্ক বহাল থাকায় বাংলাদেশের পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যা সেখানকার মূল্যসংবেদনশীল বাজারে চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে।
সানেম এর এই নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা, নীতিগত দ্বিধা এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন তৈরি হওয়ায় সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি পারফরম্যান্স প্রভাবিত হতে পারে।
তিনি বলেছেন, ওয়াশিংটনের লবিং প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাস, কূটনৈতিন মিশন ও প্রবাসী ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্য সমন্বয় করলে দেশের স্বার্থের কন্ঠস্বর শক্তিশালী হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে "বাংলাদেশকে রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রচলিত রফতানি বাজারের বাইরেও নতুন বাজার বিশেষত এশীয়ার বাজারগুলোয় প্রবেশের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।" পরিবর্তিত বাণিজ্য পরিস্থিতির মোকাবিলায় তিনি কয়েকটি প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপের পরামর্শ দেন:
প্রথমত, সরকারের উচিত একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করা, যেখানে নীতিনির্ধারক, রফতানিকারক, শিল্প সংগঠন, গবেষক এবং কূটনীতিকরা একসাথে বসে আসন্ন বাণিজ্য আলোচনার জন্য একটি বাস্তবভিত্তিক ও সময়বদ্ধ কৌশল প্রণয়ন করবেন।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য একটি গঠনমূলক কাঠামো তৈরি করা জরুরি, যা ইউএসটিআর নির্ধারিত অগ্রাধিকার যেমন শুল্কমুক্ত বাণিজ্য, অশুল্ক বাধা কমানো এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব শুল্ক কাঠামোতেও সংস্কারের সুযোগ তৈরি হতে পারে, যা বর্তমানে উচ্চ কাস্টমস ডিউটি ও প্যারাট্যারিফের বোঝায় ভারাক্রান্ত।
তৃতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি একটি প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কাস্টমস, গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, বাজার প্রবেশাধিকার এবং পণ্যের নিরাপত্তা বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নিজেদের সক্ষম করে তুলতে হবে, যাতে বাণিজ্য আরও সহজ ও দ্রুত হয়।
পরিশেষে সম্ভাব্য 'সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি'র জন্যও প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, "বিকল্প বাজার খুঁজে বের করা এবং নতুন পণ্যের রফতানি প্রসারে জোর দিতে হবে, যাতে কোনো একটি নির্দিষ্ট বাজার বা খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমানো যায়।" "এটি এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ, যেখানে সুস্পষ্ট কৌশল, সমন্বিত উদ্যোগ এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের প্রয়োজন," মন্তব্য করেন সানেম নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, "আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ৩৭ শতাংশ শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।"
তিনি আরও বলেন, "এটি শুধু বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নয়, বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত করতেও ভূমিকা রাখবে। এমনকি আন্তর্জাতিক শেয়ারবাজারেও ইতিবাচক প্রতিফলন পড়েছে।"
"আমাদের মূল সংলাপ অংশীদার ইউএসটিআর। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের দূতাবাস এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের উপযোগী ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও মজবুত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করছি," বলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। ●
অকা/তৈপোশি/ই/দুপুর, ১১ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 month আগে