অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
এক সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বর্তমানে পুঁজি বাজারে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না। উল্টো নিজেই রয়েছে পুঞ্জীভূত লোকসানে। এ অবস্থায় তারল্য সংকট মেটাতে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইসিবি। পুঁজি বাজারের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের পুঁজি বাজারের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে প্রায় পাঁচ দশক আগে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সৃষ্টি।
আইসিবির আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩-২৪ হিসাব বছর শেষে প্রতিষ্ঠানটির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১৮২ কোটি টাকায়। এর মধ্যে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে ১২ হাজার ৯১৩ কোটি ও তালিকাবহির্ভূত সিকিউরিটিজে ১ হাজার ১১৬ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ড খাতে আইসিবির সমন্বিত বিনিয়োগের পরিমাণ ৮৯৯ কোটি টাকা। এদিকে ৩১ মার্চ শেষে আইসিবির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ১৪ হাজার ১৬৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ট্রেজারি বন্ডে প্রতিষ্ঠানটি ৩০৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। গত বছরের জুন শেষে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৮ কোটি টাকা। মূলত ট্রেজারি বন্ডের উচ্চসুদের কারণে বেশি রিটার্নের আশায় এ খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে আইসিবি।
আইসিবির কর্মকর্তারা বলছেন, পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের জন্য প্রতিষ্ঠানটির সৃষ্টি হলেও বেশকিছু ভুল নীতির কারণে এর আর্থিক সক্ষমতা কমে গেছে। পুঁজি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন শঙ্কার কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে আইসিবিকে শেয়ার বিক্রি করতে দেয়া হয়নি। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই শেয়ার বিক্রি করে মূলধনি মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে তহবিল বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ফ্লোর প্রাইস থাকার কারণেও আইসিবির তারল্য প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে নিয়মানুসারে আইসিবি লোকসানে শেয়ার বিক্রি করতে পারে না। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটির তারল্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাঘাত ঘটেছে। অবশ্য সম্প্রতি এ নিয়ম পরিবর্তনের ফলে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে শেয়ার বিক্রির অনুমোদন পেয়েছে।
পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান দিতে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক, অন্যান্য ব্যাংক এবং প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ ও আমানত নিয়েছে আইসিবি। এর মধ্যে গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে ৮১৭ কোটি এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের কাছ থেকে ৩ হাজার ২৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। তাছাড়া এ সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ২২৭ কোটি টাকায়। এসব ঋণ ও আমানতের বিপরীতের সুদ বাবদ বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে আইসিবিকে। গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে সুদ বাবদ ৬৯৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এর বিপরীতে এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটির সুদ বাবদ আয় হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ হিসাব বছরে আইসিবির সুদ বাবদ ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯০৬ কোটি টাকা।
তারল্য সংকট মেটাতে গত বছরের ডিসেম্বরে সরকারের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা নিয়েছে আইসিবি। ৪ শতাংশ সুদে নেয়া এ ঋণের ২ হাজার কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যমান ঋণ পরিশোধে এবং বাকি ১ হাজার কোটি টাকা পুঁজি বাজারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। তবে সরকারের কাছ থেকে এ ঋণ সুবিধা পাওয়ার পরও আইসিবির তারল্য সংকট কাটেনি। এর ফলে পুঁজি বাজারের বর্তমান মন্দা অবস্থায়ও প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত এ বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় তারল্য সংকট মেটাতে বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডগুলোয় আইসিবি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির বিনিয়োগ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের জুন শেষে বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে আইসিবি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তারল্য সংকটের কারণে আইসিবি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি নতুন বিনিয়োগে যেতে পারছে না। এ অবস্থায় বেমেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডে আইসিবি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে পুরো বিনিয়োগ প্রত্যাহার হবে না। যতটা সম্ভব প্রত্যাহার করার কথা বলা হয়েছে। এরই মধ্যে বিনিয়োগ ফেরত আনার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কেউ কেউ কিছু টাকা ফেরতও দিয়েছে।’
একদিকে তারল্য সংকটের কারণে পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের জোগান পাচ্ছে না আইসিবি। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং দুর্বল কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখার কারণে প্রতিষ্ঠানটির বড় অংকের অর্থ আটকে রয়েছে। গত ৩১ মার্চ শেষে আইসিবির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৫২ কোটি টাকায়। গত বছরের জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ৭৯০ কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংকে ১৫৪ কোটি টাকার আমানত রেখেছে আইসিবি। পাশাপাশি ব্যাংকটিতে ৮৫ কোটি টাকার ইকুইটি বিনিয়োগও করেছে। তাছাড়া পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে ২৫ কোটি, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সে ৪৭ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্সে ৫৬ কোটি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ৪৭ কোটি, ফার্স্ট ফাইন্যান্সে ১৬১ কোটি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে ১৯১ কোটি ও ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ১৩৪ কোটি টাকার আমানত রয়েছে আইসিবির।
আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মুদ্রাবাজার থেকে উচ্চ সুদে ধারদেনা করে পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের জন্য আইসিবিকে তহবিল নিতে হয়েছে। এরই মধ্যে বেশকিছু ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আমরা সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে পারিনি। এগুলো পরিশোধের বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি চাপও রয়েছে। পুঁজি বাজারের বিদ্যমান অবস্থার কারণে সেভাবে শেয়ার বিক্রি করাও সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে মিউচুয়াল ফান্ড থেকে কিছুটা বিনিয়োগ প্রত্যাহারের বিষয়ে আমাদের পর্ষদে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে যেসব মিউচুয়াল ফান্ড থেকে নিয়মিত লভ্যাংশ পাওয়া যাচ্ছে না কিংবা ভালো রিটার্ন আসছে না সেগুলো থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হবে। বেশকিছু প্রকল্পে বিনিয়োগের টাকা আটকে যাওয়ার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তাছাড়া কিছু প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানতও আটকে রয়েছে।’
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘সবার আগে আইসিবিতে কাঠামোগত সংস্কার করা প্রয়োজন। প্রয়োজন হলে এটিকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে।
একসময় পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় থাকলেও ধীরে ধীরে আইসিবি সে অবস্থান হারাতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের বিতর্কিত বিনিয়োগ এবং পুঁজি বাজারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন প্রতিষ্ঠানে অর্থায়নের কারণে আইসিবির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এতে তারল্য সংকটে পড়ে পুঁজি বাজারে বিনিয়োগের সক্ষমতা হারাতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এ অবস্থায় মিউচুয়াল ফান্ড খাত থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করা হলেও প্রতিষ্ঠানটির তারল্য সংকট কাটবে না। এতে বরং পুঁজি বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ যেসব মিউচুয়াল ফান্ডে আইসিবির বিনিয়োগ রয়েছে সেগুলো থেকে বিনিয়োগ ফেরত আনতে হলে শেয়ার বিক্রি করেই ফান্ডগুলোকে অর্থ ফেরত দিতে হবে। অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে বিতর্কিত বিনিয়োগ ও দুর্বল প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানতের অর্থ ফেরত আনতে পারছে না আইসিবি। এসব অর্থ ফেরত আনা গেলে সেটি তারল্য সংকট কাটানোর জন্য সহায়ক হতো। কয়েক বছর ধরেই আইসিবির সংস্কার নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার দিক থেকে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এক্ষেত্রে সার্বিকভাবে আইসিবির বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া এর অবস্থার পরিবর্তন হবে না বলে মনে করছেন তারা। ●
অকা/আখা/ফর/দুপুর/২৬ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 weeks আগে