অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
সাত অর্থ বছরে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও এই এলএনজি মোট সরবরাহকৃত গ্যাসের মাত্র ২০-২৫ শতাংশ। দেশে গ্যাসের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় ২০১৮ সাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার। অন্যদিকে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে দুই যুগে মাত্র ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে সরকার। যার মধ্যে ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি গ্যাস উৎপাদন কোম্পানির আওতায় কূপ খননে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে আরো অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা গ্যাসকূপ খননসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রমে ব্যয় হয়েছে বলে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে।
গ্যাস অনুসন্ধানে সীমিত এ বিনিয়োগে একদিকে যেমন গ্যাসের বড় কোনো মজুদ আবিষ্কার হয়নি, তেমনি কমানো যায়নি গ্যাসের সরবরাহ সংকট। সম্প্রতি ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানি আমদানিতে তৈরি হয়েছে বড় অনিশ্চয়তা। এ পরিস্থিতি দেশে জ্বালানি নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েই চলেছে। বাড়ছে এলএনজির দামও। এরই মধ্যে সরকার বিকল্প উৎস অনুসন্ধান শুরু করেছে। বাংলাদেশের জ্বালানি আমদানির বড় উৎস মধ্যপ্রাচ্য। বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান ও কুয়েত থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল ও এলএনজি আমদানি করে বাংলাদেশ। এসব পণ্য আমদানি হয় হরমুজ প্রণালি দিয়ে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে এরই মধ্যে জাহাজ ও ট্যাংকারের ভাড়া ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। জাহাজ ভাড়া ও প্রিমিয়াম চার্জ দফায় দফায় বাড়াচ্ছে পণ্য পরিবহনকারী আন্তর্জাতিক জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। জাহাজের প্রিমিয়াম চার্জ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি এরই মধ্যে পর্যবেক্ষণ করছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে উপসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ জড়িয়ে পড়লে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন বাংলাদেশের জ্বালানি আমদানির রুট পরিবর্তন করতে হলে দেশে জ্বালানির দাম ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানি আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে তা দেশের জ্বালানি খাতের নিরাপত্তাকে তীব্র ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে বলে মনে করেন তারা।
গ্যাসের চাহিদা বিবেচনায় আমদানির প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তা এতটা বাড়ানো উচিত নয়, যা সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। যুদ্ধের কারণে সরবরাহ সংকটের ঝুঁকির পাশাপাশি দামেও উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এলএনজি সরবরাহ কার্যক্রম প্রতি বছর ব্যাহত হচ্ছে। এত ঝুঁকি নিয়ে দেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনা নিরাপদ রাখা চ্যালেঞ্জিং। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় গ্যাস খাতের সরবরাহ বড় আকারে বাড়ানোর পরিকল্পনা ও বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দেশের গ্যাস খাতে টেনে আনার জোর চেষ্টা করা উচিত বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
যদিও জ্বালানি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জ্বালানির স্থানীয় বিনিয়োগ ও গ্যাস পেতে জোরালো উদ্যোগ চলমান রয়েছে। পাশাপাশি আমদানির বহুমুখী উৎস তৈরি করতে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে।
২০১৮ সালে এলএনজি আমদানির শুরুতেই বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা ছিল। বিশেষ করে আমদানিতে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পেট্রোবাংলাকে বিদেশী ঋণ, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) ব্যবহার করতে হয়েছে।
২০১৮-১৯ অর্থ বছরে অর্থাৎ এলএনজি আমদানি শুরুর বছরে পণ্যটি কিনতে ব্যয় করা হয়েছে ১১ হাজার ৮১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ১৭ হাজার ৫০২ কোটি ৯৮ লাখ, ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৬ হাজার ৫০৫ কোটি ৯৭ লাখ, ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৪০ হাজার ৫৬২ কোটি ৭৭ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৩৫ হাজার ২৭৪ কোটি, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৪২ হাজার ৮৪৪ কোটি ৬৯ লাখ এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে সাময়িক হিসাব অনুযায়ী ৪০ হাজার ৭৫২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
সাত অর্থ বছরে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করা হলেও গ্যাস অনুসন্ধানে বড় কোনো অর্থ বিনিয়োগ করা যায়নি। বিশেষ করে এলএনজি আমদানির ১০ শতাংশ অর্থ যদি গ্যাস খাতে বিনিয়োগ করা যেত তাহলে স্থানীয় গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদের বিষয়ে একটা ধারণা পাওয়া যেত বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা।
দেশে বিদেশী তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানির হিসাব বাদ দিলে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন গ্যাস কোম্পানি বাপেক্স, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) মাধ্যমে গত দুই দশকের কিছু বেশি সময় ধরে মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে।
গ্যাস খাতের উৎপাদন, সরবরাহ পরিস্থিতি, গ্যাসকূপ খনন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে গত বছরের ১৫ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে পেট্রোবাংলা। এ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে দেশে গ্যাসকূপ খননে বিনিয়োগ হয়েছে ৬ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। এ সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি কোম্পানির আওতায় মোট ৫৯টি গ্যাসকূপ খনন করা হয়েছে। সীমিত এ অর্থে খননকৃত ১৮টি অনুসন্ধানমূলক কূপের ৫০ শতাংশেই গ্যাস পাওয়া গেছে। আর কূপ খনন করে যে গ্যাস পাওয়া গেছে তা বিক্রি বাবদ আয় হয়েছে মোট ৩৩ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। এ খাতে ৩৮৭ শতাংশ মুনাফা করেছে উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলো।
অন্যদিকে একই সময়ে বিদেশী তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী কোম্পানি দেশে মোট আটটি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে। এর মধ্যে গ্যাস পেয়েছে কেবল দুটিতে। সে হিসেবে বিদেশী কোম্পানির সফলতার হার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির অর্ধেক, ২৫ শতাংশ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ‘প্রতি বছর সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ এলএনজি আমদানিতে ব্যয় করছে। অথচ এ আমদানিনির্ভরতার নানা ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশ তীব্র ঝুঁকি নিয়ে আমদানিতে ভরসা রাখছে। আমাদের উচিত স্থানীয় গ্যাসে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং এর মাধ্যমে বৃহৎ আকারে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে গ্যাসের মজুদপ্রাপ্যতার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বিভিন্ন সময় হচ্ছে। আগামীতেও এসব বাড়তে থাকবে। ফলে এসব অঞ্চলে আমাদের যে গ্যাস আমদানির উৎস রয়েছে সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী তা নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা হওয়া দরকার। নতুবা সামনে বড় ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।’
দেশে ক্রমেই গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করা যায় ২০২৩ সালে। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দামে উল্লম্ফন, ডলার সংকটসহ টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার তিন বছর মেয়াদি কূপ খননের প্রকল্প হাতে নেয়। এর লক্ষ্য ছিল ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৪৮টি গ্যাসকূপ খনন করে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে যুক্ত করা।
বিগত সরকারের সময়ে নেয়া ৪৮ কূপ খননের প্রকল্পটি অন্তর্বর্তী সরকারও বাস্তবায়ন করছে। এর পাশাপাশি ২০২৮ সালের মধ্যে নতুন করে ১০০ গ্যাসকূপ খনন শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১০০ কূপ খননের এ প্রকল্পে সরকার অন্তত ১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করবে।
দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে বড় পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে পেট্রোবাংলা। বিশেষ করে বাপেক্সের রিগ দিয়ে কূপ খননের পাশাপাশি বিদেশ থেকে রিগ ভাড়া করার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শোয়েব বলেন, ‘স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আরো বড় আকারে স্থলভাগে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পিএসসি হালনাগাদ করা হয়েছে। পাহাড়ি এলাকাকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। এতে পার্বত্য এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম আরো জোরালো হবে। নতুন পিএসসির মাধ্যমে স্থলভাগের সম্ভাব্য এলাকাগুলোও অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
দেশে গত দুই দশকে বিভিন্ন সরকার অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়েছে কিন্তু সেই কার্যক্রম গ্যাস চাহিদার তুলনায় যৎসামান্য। স্থল ভাগে আরো বড় আকারে অনুসন্ধানের সুযোগ ও সময় ছিল বলে মনে করেন বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভূতত্ত্ববিদ মর্তুজা আহমদ ফারুক চিশতী। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে বাপেক্সের নিজস্ব কিছু কার্যক্রম সবসময় ছিল। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। সুযোগ ছিল স্থলভাগে বাপেক্সের পাশাপাশি বিদেশী কোম্পানি এনে বৃহৎ আকারে অনুসন্ধান জরিপকাজ চালানো। কিন্তু সেটি আইনি কিছু জটিলতার কারণে করা যায়নি। অথচ আমরা বাপেক্সের সক্ষমতার কাজ বিদেশী ঠিকাদার দিয়ে করিয়েছি। দেশে গ্যাস চাহিদার বিবেচনায় এলএনজি আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানটাও জোরালো হওয়া উচিত ছিল। বলতে গেলে প্রায় দুই দশক দেশে পাহাড়ে, স্থলভাগ, দক্ষিণাংশে এক্সপ্লোরেশনের কোনো কাজ হয়নি।’
গ্যাসের সরবরাহ সংকটের বিষয়টি মাথায় রেখে বহুমুখী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে জানিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথমত, গ্যাস অনুসন্ধানে জরিপ, কূপ খনন, রিগ ক্রয় ও দক্ষ জনবলের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম রয়েছে। এসব কারণে জ্বালানি খাতে বিগত অর্থবছরের তুলনায় দ্বিগুণ অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এসব কার্যক্রম নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বিপুল পরিমাণ গ্যাস আমদানি ব্যয় কমাতে কীভাবে স্থানীয় বিনিয়োগ বাড়িয়ে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। ●
অকা/জ্বালানি/ফর/দুপুর/১৯ জুন, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 weeks আগে