প্রণব মজুমদার ●
দেশের শেয়ার বাজারে ১৯ আগস্ট সূচক সামান্য কমলেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও অপর বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) লেনদেন বেড়েছে। খবর ডিএসই ও সিএসইর। এদিন ডিএসইতে ৮০৭ কোটি ১৫ লাখ টাকার শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়, যা আগের কার্যদিবসের চেয়ে প্রায় ৩২৭ কোটি টাকা ছিল বেশি। আগের দিন ডিএসইতে ৪৮০ কোটি ৮৯ লাখ টাকার শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়েছিল। ১৯ আগস্ট ডিএসইতে ৩৯৬টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। এগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছে ১১৯টি কোম্পানির, কমেছে ২৪৭টি এবং অপরিবর্তিত ছিল ৩০টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিটের দর। লেনদেনের শীর্ষে থাকা এদিন ১০টি প্রতিষ্ঠান ছিল- গ্রামীণফোন, ব্র্যাক ব্যাংক, অলিম্পিক, অরিয়ন ফার্মা, জেএমআই হসপিটাল, সী পার্ল, স্কয়ার ফার্মা, রবি, আইএফআইসি ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংক।
দেশের পুঁজি বাজারের লুণ্ঠনকারি এবং বিভিন্ন সময় কেলেংকারির সঙ্গে যুক্ত দুর্নীতিবাজরা সরকার পতনের আগে ও পরে অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছে। মূল হোতা ধরা পড়ে এখন কারাগারে! ফলে লোপটকারী বেশির ভাগ বাজারে না থাকায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আশা করা যায় -বাজারে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। বিনিয়োগকারীরাও তাই প্রত্যাশা করছেন।
২০১২ সালের ২১ আগস্ট দেশের শেয়ার বাজারের হতশ্রী নিয়ে বাংলা নিউজ ২৪ ডটকমে লিখেছিলাম। যা আজকের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা। ফেইসবুক বন্ধু ফালগুনী রহমানের স্ট্যাটসে একটি ছবি! বিষয়টি ছিল বেশ স্পর্শকাতর ও ভাবনার।
রাজধানীর লালবাগে অনাহারী দুই সহোদরা। ক্ষুধার জ্বালায় কাতর। খেতে চেয়েছিলো ওরা। অপরদিকে লুটপাটকারী কটি হাস্যেজ্জ্বল এবং সমাজ শাসানো শাণিত মুখাবয়ব (যারা এখন পলাতক ও কারাগারে)।
ক্ষুধা নিবারণ আর তখনকার শেয়ার বাজার কেলেংকারিতে অভিযুক্ত রাঘব বোয়ালদের নিয়ে একটি ক্যানভাসে পাশাপাশি দুটি ছবি। ক্যাপশনে সত্য প্রকাশের এক নিগূঢ় বাস্তবতা স্পষ্ট। একটি ক্যাপশন- ‘ক্ষুধার জ্বালায় হতভাগ্য দুবোন একটুু খাবার চুরি করেছিলো বীর বাঙালি তাই ওদের ক্ষমা করেনি।’ অপর ছবিটি দেশের ৬ জন ‘বিশিষ্ট শিল্পপতি’ ও শেয়ার ব্যবসায়ীর। এরা ছিলেন ‘সাএফর’, ‘আহমমোকা’, ‘মোআফা’, ‘এইচবিএমই’, ‘লুরবা’ ও ‘নূরা’।
বিশিষ্ট ব্যাংকার প্রয়াত খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে প্রকাশিত শেয়ার কেলেংকারির তদন্ত প্রতিবেদন সংক্রান্ত খবরের পত্রিকা শিরোনাম -অভিযোগের শীর্ষে যারা। নিচে ক্যাপশনে লেখা-‘এনারা বিশিষ্ট সৈয়দ বংশীয় চোর, হাজার কোটি টাকা চুরি করলেও বীর বাঙালি এদের নাগাল পায়নি।’ কোলাজ ছবি দুটি ছিল কর্মময় জীবনের এক বড় প্রতিবাদ। বিশেষ করে তাদের কাছে, যারা বুঝে বা না বুঝে ডেসটিনি ভেবে দেশের শেয়ার বাজারে পুঁজি হারিয়ে নিঃম্ব। এ প্রতিবাদের ভাষা তাদের স্বজনদের, যারা এখানে বিনিয়োগ হারিয়ে জীবন দিয়ে গেছেন। ফালগুনীর সে স্ট্যাটাসে ছবি দুটি সম্পর্কে ৫ জনের বিরূপ মন্তব্য ছিল। লেখার বিষয়টির সঙ্গে উল্লেখিত বিদ্রুপাত্মক এবং সংবেদনশীল হৃদয়স্পর্শী ঘটনাগুচ্ছের বেশ মিল ছিল।
আমরা যারা শ্রমজীবী মানুষ, দৈনিক কাজ না করলে আহার জোটে না; বিষয়গুলো নিয়ে অসহায় আমাদের শুধু চিন্তা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। গণপিটুনি খাওয়া ওই দুবোনের সঙ্গে পার্থক্য এটুকুই, ওদের উর্পাজন করার মেধা বা জ্ঞান নেই যা দেশের শেয়ার বাজার লুণ্ঠনকারীদের ছিল। আর হাজার কোটি টাকা লুটপাটকারী ‘সৈয়দ বংশীয় চোর’ নামের রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে রুটি রুজির সন্ধানে ব্যস্ত থাকা তফাৎ -আমরা চৌর্যবৃত্তির কৌশল জানি না। যে ‘মহাজ্ঞানের’ মহিমায় ওই ৬ জন ‘মহারথী’ সমাজে, রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্রের নানা কার্যক্রম, অবৈধভাবে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ এবং শেয়ার বাজার ম্যানুপুলেশনসহ অন্যান্য কেলেংকারিতে নিযুক্ত ছিল।
কেন দু বোন চুরি করে খেয়েছিলো? ওদের মা বাবা কি রোজগার করতে অক্ষম? নাকি ওরা অনাথ? সে জন্যই কি ওরা এ অন্যায় করেছিলো? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে না ফিরে বরং শাস্তি ওদের আমরা দিয়েছি। কিন্তু পুকুর চোরদের কিছুই আমরা করতে পারিনি। কেননা সরকারের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে থাকা তাদের টিকির নাগাল আমরা পাইনি। সকল সরকারের আমলেই এসব রাঘব বোয়ালরা আদর যত্ন পান। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এদের কদর করে। যাদের চাঁদা ও পৃষ্টপোষকতায় সরকারি এবং বড় দলগুলোর উজ্জীবিত থাকে। বড় বড় অংকের আয়কর ফাঁকি দিয়েও এরা পার পেয়ে যায়। অনেক সময় বিশেষ সুবিধার কাছে সে খবরও ধামাচাপা পড়ে যায়! আর সরকারের ঘাটতি করের বোঝার অধিকাংশ পরোক্ষ করের মাধ্যমে সামলাতে হয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে।
অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থান- জনগণের এ মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের। সংবিধানেও সে কথা বলা আছে। জনগণের নিরাপত্তা সেটা জীবন বা জীবিকার যেটাই হোক না কেন তা পালনের দায়িত্বও রাষ্ট্রের। ২৭ লাখ বিও (বেনিফিসারি ওনার্স) হিসাবধারীর পুঁজি হারাতে হলো কেন তখন? ‘যারা’ শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর পুঁজি লুণ্ঠনকারী তাদের কেন বারবার ‘ক্ষমা’ করেছিল সরকারগুলো?
দেশের পুঁজি বাজারে আস্থার সংকটের কথা দীর্ঘ সময় ধরেই। বাজারে আস্থা পুনরুদ্ধারে কেউই আন্তরিক ছিল হয় না। ’৯৬ সালের শেয়ার কেলেংকারির ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমীরুল ইসলাম চৌধুরী কমিটির প্রকাশ করা সেই তদন্ত প্রতিবেদনের বিচার আজও হয়নি। অভিযুক্তরা পুনর্বাসিত হয়েছেন। বিচারের বদলে ‘ক্ষমা’ পেয়ে পুঁজি বাজারের এই লুটপাটকারীরা বরং বীর বাঙালির মতো অস্ত্র ধরে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের হত্যা করেছিলেন। কলঙ্কজনক সেই ঘটনার অভিযুক্ত একজন ছিলেন ঢাকার শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের (ডিএসই) সভাপতি, যিনি এখন পৃথিবীতে নেই। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন ৪৫ জন। যারা বেঁচে আছেন; তাদের এখন বিচার হওয়া উচিত। বছরের পর বছর লুণ্ঠনকারী এরা দেশের শেয়ার বাজারকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে গেছেন।
২০১০ সালের দেশের শেয়ার বাজারে পুনরায় কেলেংকারি সংঘটিত হয়। কেলেংকারির সঙ্গে উল্লেখিতরাও জড়িত ছিল। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা নিয়ে তখন সরকারের মেলোড্রামা মঞ্চস্থ হয়! কমিটির প্রধান সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে অপ্রত্যাশিত এবং বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়? আজ প্রবীণ ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বেঁচে নেই!
সময় অনেক অতিবাহিত হয়েছে। কালক্ষেপণ আর নয়। আমীরুল ও খালেদ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অপরাধীদের ‘আদর’ না করে যোগ্য বিচারসহ কমিটির সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করার জোর পরামর্শ দেই সরকারকে। তা করা গেলে দেশের পুঁজি বাজারে আস্থা বা বিশ্বাস ফেরানো সম্ভব হবে। কেননা, পুঁজি বাজার দেশের তৃণমূলে এখন বিস্তৃত। আর বিনিয়োগকারীদের বৃহৎ গোষ্ঠী দেশের বড় এক ভোট ব্যাংকও বটে। তাছাড়া, অর্থনীতিতে বড় স্থান দখল করে থাকে যে কোন দেশের পুঁজি বাজার। ●
অকা/পুঁবা/নিলে/সকাল/২১ আগস্ট, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
২১ আগস্ট, ২০২৪
লেখক কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক
reporterpranab@gmail.com
সর্বশেষ হালনাগাদ 9 months আগে