অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) প্রস্তাবিত ব্যাংক কোম্পানি আইন, ২০২৫ সংশোধনীর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে। সংগঠনটি মনে করে, ব্যাংক পরিচালনা ও মালিকানা কাঠামোর ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণের বদলে শেয়ারহোল্ডারদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং পরিচালকদের ভূমিকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করা প্রয়োজন।
রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে বিএবির চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার বলেন, আইনকে বাস্তবমুখী ও টেকসই করতে পরিবার ও শেয়ার মালিকানার সংজ্ঞা পুনঃনির্ধারণ, ভোটাধিকার সীমাবদ্ধতা বাতিল, পরিচালক-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মূল্যায়ন কাঠামো প্রবর্তন জরুরি।
পরিবারের সংজ্ঞা
বর্তমান আইনে পরিবার বলতে স্ত্রী, স্বামী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন ও নির্ভরশীলদের বোঝানো হয়।
বিএবির প্রস্তাব হলো—পরিবারের সংজ্ঞা সীমিত করে শুধু স্বামী-স্ত্রী ও নির্ভরশীল সন্তান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা।
তাদের মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোতে পরিবারের সংজ্ঞা অনেক সরল। যেমন ভারতে পরিবার বলতে বোঝানো হয় শুধু স্বামী-স্ত্রী বা হিন্দু অবিভক্ত পরিবার, পাকিস্তানে স্বামী-স্ত্রী ও নির্ভরশীল সরাসরি বংশধর, আর শ্রীলঙ্কায় শুধু স্বামী-স্ত্রী বা নির্ভরশীল সন্তান।
শেয়ার ধারণের সীমা
বর্তমানে একজন শেয়ারহোল্ডার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার রাখতে পারেন। বিএবি প্রস্তাব করেছে, এ সীমা বাতিল করে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের জন্য ২৫ শতাংশ বা তার বেশি পর্যন্ত শেয়ার রাখার সুযোগ দেওয়া হোক।
সংগঠনটির মতে, এতে বড় শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে মালিকানা বোধ, দায়িত্বশীলতা ও সুশাসন বাড়বে। কারণ ব্যাংক দুর্বল হলে তাদের বিনিয়োগও ঝুঁকির মুখে পড়বে। অন্যদিকে কঠোর সীমাবদ্ধতা থাকলে বিনিয়োগকারীরা পরোক্ষভাবে শেয়ার কিনতে আগ্রহী হন, যা নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিকে জটিল করে তোলে।
ভোটাধিকার
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি ৫ শতাংশের বেশি শেয়ারধারী হন, তবুও তারা মোট ভোটের ৫ শতাংশের বেশি প্রয়োগ করতে পারবেন না।
কিন্তু বিএবি এটিকে পুরোপুরি বাতিল করতে চায়। তাদের মতে, এটি কোম্পানি আইন, ১৯৯৪–এর "এক শেয়ার, এক ভোট" নীতির পরিপন্থী এবং শেয়ারহোল্ডারদের অধিকার সীমিত করে।
পর্ষদ গঠন ও পরিচালক
বর্তমান আইনে একই পরিবারের সর্বোচ্চ তিনজন পরিচালক হতে পারেন। খসড়া সংশোধনীতে এটি কমিয়ে দুইজন করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিএবি এই সীমা শিথিল বা বাতিলের দাবি করেছে।
তাদের মতে, পরিবার থেকে বেশি পরিচালক থাকলে ব্যাংকের প্রতি অঙ্গীকার, বিনিয়োগের দায়বদ্ধতা ও মনোযোগ বাড়বে।
স্বতন্ত্র পরিচালক
বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংকে ২০ জন পরিচালক থাকতে পারেন, যার মধ্যে অন্তত ২-৩ জন স্বতন্ত্র পরিচালক হতে হয়। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে সংখ্যা কমিয়ে সর্বোচ্চ ১৫ জন রাখা এবং অর্ধেককে স্বতন্ত্র করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিএবি মনে করে, এতে বাস্তব অভিজ্ঞতা কমে যাবে, শেয়ারহোল্ডারদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষীণ হবে এবং ব্যাংকগুলো কেবল নীতিপালনমুখী হয়ে পড়বে। তাই তারা আগের বিধান বহাল রাখার প্রস্তাব দিয়েছে।
অন্য ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একাধিক ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য শেয়ার রাখতে পারবেন না, কেবল ২ শতাংশ পর্যন্ত রাখা যাবে।
বিএবির মতে, এটি বিনিয়োগ সীমিত করবে, দুর্বল ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগাড়ে বাধা দেবে এবং বাজার তারল্য কমাবে। পাশাপাশি সংবিধানের ব্যবসা ও সম্পত্তির অধিকারের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে।
পরিচালকের মেয়াদ
বর্তমানে একজন পরিচালক সর্বোচ্চ ১২ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারেন। খসড়া আইনে এটি ৬ বছর করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
বিএবির মতে, এটি অত্যন্ত সীমিত। তারা মেয়াদ ৯ বছর রাখার সুপারিশ করেছে। তাদের যুক্তি, দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞ পরিচালকরা ব্যাংকিং খাতের কৌশলগত নেতৃত্ব ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।
খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত শর্ত
বর্তমানে খেলাপি হলে পরিচালক পদ শূন্য হয় এবং এক বছরের জন্য পুনঃনিযুক্ত হওয়া যায় না। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণেও পরিচালককে দায়ী করা হবে এবং ৩ বছরের জন্য পুনঃনিয়োগ নিষিদ্ধ থাকবে।
বিএবি প্রস্তাব দিয়েছে, এই সময়সীমা ৬ মাস করা হোক।
পরিচালক নিয়োগ
বর্তমান আইন অনুযায়ী, একজন পরিচালক একসঙ্গে অন্য ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বিমা কোম্পানির পরিচালক হতে পারেন না। প্রস্তাবিত আইনে এটি বহাল রাখা হয়েছে।
বিএবি মনে করে, বিধিনিষেধ শুধু অন্য ব্যাংক কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত। এতে অভিজ্ঞ পরিচালকরা বিভিন্ন খাতে অবদান রাখতে পারবেন এবং পরিচালনা পর্ষদের স্থিতিশীলতা বাড়বে।
মূল্যায়ন কাঠামো
বিএবির প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংকের পরিচালনা কাঠামো নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্যামেলস, সাস্টেইনেবিলিটি, রিস্ক রেটিং ও পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করতে হবে।
তাদের মতে, এতে ভালো ব্যাংকগুলো পুরস্কৃত হবে, দুর্বল ব্যাংকগুলো সংস্কারের আওতায় আসবে এবং ফলাফলভিত্তিক একটি ভারসাম্যপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে।
সামগ্রিক বিশ্লেষণ
বিএবির এসব প্রস্তাব মূলত ব্যাংক মালিকানা ও পরিচালনায় শিথিলতা আনার দিকে ইঙ্গিত করে, যা শেয়ারহোল্ডারদের অংশগ্রহণ বাড়াবে বটে, তবে তদারকি ও সুশাসন নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক একদিকে আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে চাইছে, অন্যদিকে ব্যাংক মালিকেরা শেয়ার ও পরিচালনায় বেশি স্বাধীনতা চাইছেন। শেষ পর্যন্ত কোন ভারসাম্য তৈরি হয়, তা ব্যাংক খাতের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 4 days আগে