অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি এখন রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। একসময় সরকারি অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত এই ব্যাংকগুলো ক্রমে আস্থাহীনতা, লোকসান ও খেলাপি ঋণের ফাঁদে জর্জরিত হয়ে পড়ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন শেষে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা, যা মাত্র ছয় মাসে বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। উদ্বেগজনক বিষয় হলো—এই খেলাপি ঋণের ৯০ শতাংশেরও বেশি ‘ক্ষতি’ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত, যা আর পুনরুদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নেই।
অর্থনীতিবিদদের মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এই সংকট হঠাৎ তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর রাজনৈতিক প্রভাব, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, দুর্বল কর্পোরেট গভর্নেন্স ও অস্বচ্ছ ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মূলধন ঘাটতি, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে পর্যাপ্ত প্রভিশন না রাখা, লোকসান বৃদ্ধি এবং নতুন বিনিয়োগে অনীহা ব্যাংকগুলোকে আরও দুর্বল করে তুলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় বেসরকারি ব্যাংকের সংস্কার পরিকল্পনা নিলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি এতটাই নাজুক যে, কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া এগুলোকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই কঠোর সংস্কার, পুনর্গঠন বা প্রয়োজনে একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত না নিলে এই ব্যাংকগুলো অর্থনীতির সহায়ক নয়, বরং বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক পিএলসির চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদের মতে, গত ১৫ বছরে ব্যাংকগুলোতে যে লুটপাট হয়েছে, তার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে এক-দুই বছর যথেষ্ট নয়। তার ভাষায়, খেলাপি ঋণ আসলে আরও আগেই দেখানো উচিত ছিল, কিন্তু তা না করায় এখন পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, টিকে থাকার জন্য ব্যাংকগুলোকে ডিপোজিট সংগ্রহ ও নতুন ঋণ দেওয়ার বাইরে গিয়ে রিকভারির দিকে মনোযোগী হতে হবে।
চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে জনতা ব্যাংক। ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৭৬ শতাংশই খেলাপি—পরিমাণে ৭২,১০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশ ‘খারাপ’ বা ‘ক্ষতি’ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত, যা পুনরুদ্ধারের প্রায় অযোগ্য। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার –৩.২৫ শতাংশে নেমে গেছে, যেখানে ন্যূনতম প্রয়োজন ১২.৫ শতাংশ। যদিও লোকসান কিছুটা কমেছে—প্রথম ছয় মাসে নেট ক্ষতি হয়েছে ২,০৭১ কোটি টাকা, যা আগের ছয় মাসে ছিল ৩,৭০ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে। ২০২৫ সালের জুন শেষে এর মোট ঋণের ২০ শতাংশ খেলাপি, যা আগের বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১৮.২০ শতাংশ। ইতিবাচক দিক হলো, ব্যাংকটি মূলধন সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছে। জুন শেষে এর মূলধন পর্যাপ্ততার হার দাঁড়িয়েছে ১০.১০ শতাংশ, যা ন্যূনতম ১০ শতাংশের শর্ত পূরণ করে। এ ছাড়া, প্রথম ছয় মাসে সোনালী ব্যাংক ৫৯১ কোটি টাকা নেট মুনাফা করেছে।
অগ্রণী ব্যাংকের পরিস্থিতি মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। ২০২৫ সালের জুন শেষে এর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩২,২৫৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪০.৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ ‘খারাপ’ ঋণ হিসেবে চিহ্নিত। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার মাত্র ১.৯৭ শতাংশ, যা বাধ্যতামূলক ১২.৫ শতাংশের তুলনায় বিপজ্জনকভাবে কম। যদিও ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি ১১৪ কোটি টাকা নেট মুনাফা করেছে, ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে এ খাতে ৯৩৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল।
রূপালী ব্যাংকের পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। ২০২৫ সালের জুন শেষে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২২,১৭৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৪ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এ হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৯১ শতাংশই ‘খারাপ’ ঋণ হিসেবে ধরা হয়েছে। ব্যাংকটির মূলধন পর্যাপ্ততার হার মাত্র ২.৮৬ শতাংশ, যেখানে প্রয়োজন ১২.৫ শতাংশ। বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি নেট মুনাফা করেছে মাত্র ৮.৩৪ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে ছিল ৬৪.৪৯ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বর্তমান সংকট আর কেবল মুনাফার ঘাটতির সমস্যা নয়, বরং টিকে থাকার প্রশ্ন। খেলাপি ঋণের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ, কঠোর ঋণ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কর্পোরেট গভর্নেন্স ও প্রয়োজনে একীভূতকরণের মতো পদক্ষেপ এখন জরুরি। নচেৎ দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অর্থনীতির চালিকা শক্তি না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। ●
অকা/ব্যাংখা/ই/সকাল/১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 days আগে