অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশ ও ভারত—দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত অর্থনীতির দুই দেশ—সাম্প্রতিক সময়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অশুল্ক বাধা ও বিধিনিষেধ আরোপে এগিয়ে যাচ্ছে। এ প্রবণতা শুধু বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না, বরং দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের মধ্যেও নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।
সাম্প্রতিক এক সিদ্ধান্তে ভারত স্থলবন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে চার ধরনের পাটপণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এখন এসব পণ্য কেবল সমুদ্রপথে মুম্বাইয়ের নভসেবা বন্দর হয়ে আমদানি করা যাবে। এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য বড় আঘাত হতে পারে, কারণ বর্তমানে ভারতে বাংলাদেশের মোট পাটপণ্য রফতানির ৯৯ শতাংশের বেশি হয় স্থলপথে। স্থলপথে রফতানি ব্যাহত হলে কেবল পরিবহন ব্যয়ই বাড়বে না, বরং রফতানিকারকদের অতিরিক্ত লজিস্টিকস জটিলতার মুখেও পড়তে হবে। ভারত যদিও এ সিদ্ধান্তের পেছনে মান নিয়ন্ত্রণ বা নিয়ন্ত্রক নীতির কারণ দেখাতে পারে, তবে হঠাৎ করে এবং ঘন ঘন এ ধরনের বিধিনিষেধ জারি করায় এর কৌশলগত উদ্দেশ্য নিয়ে নানা জল্পনা তৈরি হয়েছে।
তবে অশুল্ক বাধা আরোপের প্রবণতা একতরফা নয়। ২০২৪ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশও বেশ কিছু ভারতীয় পণ্যের আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে, যার মধ্যে সুতা, গুড়াদুধ ও চাল রয়েছে। এ ছাড়া ভারতীয় পণ্যের ওপর নতুন ট্রানজিট ফি আরোপ করা হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন তিনটি স্থলবন্দর বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেগুলোতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড না থাকার কথা বলা হয়েছে। যদিও এসব পদক্ষেপকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবকাঠামোগত কারণ দেখিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তবুও তা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দুই দেশের মধ্যে এসব একতরফা পদক্ষেপের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বর্তমানে বাংলাদেশ ভারত থেকে বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, অথচ রফতানি করে মাত্র প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে ভারতীয় পণ্যের ওপর বাংলাদেশ যে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করলে বা বিপরীতে ভারত বাংলাদেশের রফতানির ওপর শর্ত চাপালে, তার প্রভাব সমানভাবে পড়ে না—ভারতের পক্ষে বাণিজ্য ভারসাম্য বেশি অনুকূলে থাকে। এর ফলে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও মুক্ত বাণিজ্যের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বর্তমান বিশ্ববাণিজ্য অনিশ্চয়তা, সরবরাহ শৃঙ্খল সংকট এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উচিত পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো, যাতে শিল্পোন্নয়ন ও বিনিয়োগ প্রবাহ ধরে রাখা যায়। একে অপরের বিরুদ্ধে সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণ করলে সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়বে, উৎপাদন ব্যয় বাড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে বাজারে আস্থার সংকট তৈরি হবে।
এই পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজন ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে একটি উন্মুক্ত, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও টেকসই সংলাপের। বাণিজ্যকে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার না বানিয়ে, বরং উভয় দেশের অর্থনৈতিক সহনশীলতা ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে দেখা উচিত। এজন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এমন প্ল্যাটফর্ম তৈরি, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি খাত যৌথভাবে অশুল্ক বাধা দূরীকরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন নিয়ে কাজ করতে পারে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য যেন অর্থনৈতিক সহযোগিতার বৃহত্তর স্বার্থকে ক্ষুণ্ন না করে—বিশেষত এমন সময়ে, যখন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি মূলত অর্থনৈতিক পারস্পরিকতার ওপর নির্ভর করছে। ●
অকা/প্র/ই/সকাল/১৩ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 1 month আগে