এহসানুল আজিজ ●
ব্যাংকিং ব্যবসা সম্পূর্ণ আস্থা নির্ভরশীল ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ব্যবসা। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ Sir John Hicks তার Theory of Economic History নামক বিখ্যাত গ্রন্থে ব্যাংকিং ব্যবসার উত্থান ও বিকাশের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে আস্থা (trust) শব্দটি দুবার ব্যবহার করেছেন, ” Here loan is given to an intermediary (one of those who is trusted by prime lender) in order that he should relend to those whom he trusts.”
ব্যাংক মূলত: একটি মধ্যস্থাকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এটি আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের মধ্যস্থতা হিসেব কাজ করে। জনগণের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে লাভজনক ভাবে বিনিয়োগের মধ্যেই ব্যাংকের সাফল্য নিহিত। ব্যাংক আমানতের টাকার উপর জনগণকে সুদ/মুনাফা প্রদান করে ; অন্যদিকে, ব্যাংক আমানতের টাকা জনগণকে উচ্চতর সুদে/মুনাফায় ধার দিয়ে বা ব্যবসায় বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করে। এ মুনাফা/সুদ আয় থেকেই ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ/মুনাফা প্রদান করে, পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করে, শেয়ার মালিকদের লভ্যাংশ প্রদান করে এবং মূলধন খাতকে সংগঠিত করে। এ উভয়বিধ কার্যক্রমের মধ্যে আস্থার বিষয়টি জড়িত। ব্যাংকের উপর আস্থা না থাকলে বা নিরাপদ বোধ না করলে জনগণ সে ব্যাংকে তার আমানত রাখবে না। আবার, যথাযথ যাচাই বাছাই না করে আন্থা রাখা যায় না এমন ব্যক্তি বা ব্যবসায় বিনিয়োগ বা ঋণ প্রদান করলে সে ঋণ আটকে যাবে বা ফেরত আসবে না। আমানত হলো ব্যাংকের দায়, অন্যদিকে ঋণ/বিনিয়োগ হলো ব্যাংকের সম্পদ। ব্যাংক অত্যন্ত দক্ষতা ও নৈতিকতার সঙ্গে কাজ করে সম্পদের গুণগত মান যথাযথভাবে বজায় রাখতে সক্ষম হলেই জনগণের আমানতেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। অন্যথায়, বিতরণকুত ঋণ/বিনিয়োগ ফেরত না আসলেই ব্যাংকের সম্পদের গুণগত মান খারাপ হতে থাকে এবং ব্যাংক ব্যবসায় জটিলতা শুরু হয়। ব্যাংক জনগণের আমানতের উপর সুদ/মুনাফা প্রদান এমনকি আমানতের টাকা ফেরত দিতে ক্রমান্বয়ে অসমর্থ হয়ে পড়ে এবং ব্যাংক কঠিন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়।। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় ব্যাংক দেওলিয়ার দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়।
ঋণ/বিনিয়োগ আটকে পড়া, অনাদায়ী বা খেলাপি হওয়ার কারণ
১৯৮০-৮২ এর দিকে বি.আই.বি.এম এ অনুষ্ঠিত এক প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঋণ খেলাপির পটভূমিতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আই. এম.এফ (International Monetary Fund) এর এক সময়ের প্রখ্যাত উপদেষ্টা ড. কুলকারনী বলেন, ‘ ঋণে ব্যক্তি স্বার্থ না থাকলে ঋণ কখনও খেলাপি হয় না।’ খেলাপি ঋণের কারণ পর্যালোচনা করতে গেলে ড. কুলকারনীর বক্তব্য আজও অকাট্য প্রতীয়মান হয়। এখানে ড. কুলকারনী ঋনের ব্যক্তি স্বার্থের বিষয়টি শুধুমাত্র আর্থিক লেনদেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ বুঝান নাই। ব্যক্তি স্বার্থ নানান ভাবে সম্পৃক্ত হতে পারে - মঞ্জুর ও বিতরনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা/কর্মকর্তাদের উপর চাপ যেখানে ঋণ নাকচের সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বদলি এমনকি চাকুরি হারাবারও ভয় আছে; নিয়োগ কর্তা /উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা; মাথার উপর পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি,ভাল পোষ্টিং ইত্যাদির প্রলোভন, উর্দ্ধতন নির্বাহী /বসকে না বলার সৎ সাহস বা মানষিক শক্তির অভাব ইত্যাদিও ব্যপক অর্থে ব্যক্তি স্বার্থের পর্যায়ভুক্ত।
বস্তুত: যেসব ঋণ প্রার্থী স্বাভাবিক যোগ্যতার বিচারে ঋণ পাবার যোগ্যতা রাখেন না তারাই এ ধরনের অসৎ উপায়ের আশ্রয় গ্রহণ করে ঋণ হাতিয়ে নেয়। সুতরাং এরা যে ঋণ ফেরত দিবে না তা সহজেই অনুমেয়। মূলত: এক্ষেত্রে ঋণ যেদিন দেয়া হয়েছে সেদিনই তা খেলাপি ঋণের পর্যায়ভূক্ত হয়েছে।
আমানত হলো ব্যাংকের দায়। কতিপয় ব্যতিক্রমছাড়া জমাকৃত টাকা চাহিবা মাত্রই আমানতকারীকে ফেরত দিতে হবে। অন্যদিকে ঋণ বা বিনিয়োগ হলো ব্যাংকের সম্পদ যা মূলত: আমানত থেকেই উদ্ভুত। এ সম্পদের অর্জিত আয় থেকেই ব্যাংক আমানতকারীদের সুদ/মুনাফা ও শেয়ার মালিকদের লভ্যাংশ প্রদান এবং ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। সম্পদের গুণগত মান খারাপ হলে ব্যাংকের এসব স্বাভাবিক ও আবশ্যকীয় কর্মকাণ্ড গুরুতর ভাবে ব্যহত হয়। সম্পদের গুণগত মান তখনই খারাপ হয় যখন ব্যাপক সংখ্যক ঋণগ্রহীতা গৃহীত ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না বা ঋণ পরিশোধ এড়িয়ে চলে। এ অবস্থায় ঋণ খেলাপিদের মোটামুটি দুই ধরণে চিহ্নিত করা যায় -
● স্বাভাবিক বা অনিচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি (Natural/Unintentional default)
● ইচ্ছাকৃত বা স্বভাবগত ঋণ খেলাপি (Artificial/Willful/Habitual)
ঋণ পরিশোধের স্বাভাবিক বা অনিচ্ছাকৃত ব্যর্থতার বিষয়টির উদ্ভব ঘটে ঋণগ্রহীতা যখন .নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির শিকার হয়ে ব্যবসায় মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন এবং ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন। এরা সাধারণত স্বভাব সুলভ ভাল ঋণগ্রহীতা। উদাহরণ স্বরূপ, কোভিড-১৯ কালে ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফলে স্বভাবতই অনিচ্ছা সত্বেও এসব ব্যবসায়ীগণ ঋণ পরিশোধে অসামর্থ্য বা ব্যর্থ হতে পারেন। এ পরিস্থিতিতে খেলাপি/শ্রেনীবিন্যাসিত দায় নিয়মিতকরণ ও আদায়ের জন্য ঋণগ্রহীতাকে বর্ধিত সময় ও সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ সূচি পুন:তফসিল করতে হবে।
পুন:তফসিলের বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার নং বি.আর.পি.ডি - ১৫ তারিখ ২৩.০৯.২০১২ এর মাধ্যমে ব্যাংক গুলোকে পরিস্কার দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এখানে সার্কুলারে বর্ণিত নীতিমালাসমূহ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো :
● ঋণ পুন:তফসিল বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক অনুমোদিত নিজস্ব নীতিমালা থাকতে হবে। প্রণীত নীতিমালার শর্তসমূহ বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্তসমূহের চেয়ে অধিকতর কঠোর হতে হবে। নীতিমালায় একই দায়ের বারবার পুন:তফসিল বা অনুৎপাদনশীল খাতের ঋণ পুন:তফসিল পরিহার করার নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। তবে কোন কোন সেক্টর বা ব্যবসার শ্রেণিকৃত দায় পুন:তফসিলের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নির্দেশনার ব্যতিক্রম হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যথাযথ যৌক্তিকতার আলোকে পুন:তফসিল করতে হবে।
● যখন কোন ঋণগ্রহীতা তার কোন খেলাপি/শ্রেণিকৃত ঋণ পুন:তফসিলের জন্য আবেদন করেন তখন তার আবেদনটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা,নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে তার ঋণটি কেন খেলাপি তা নির্ণয় করতে হবে। পরীক্ষান্তে যদি প্রতীয়মান হয় যে গ্রাহক ঋণের টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছেন বা গ্রাহক একজন ইচ্ছাকৃত বা স্বভাবগত ঋণ খেলাপি সেক্ষেত্রে ব্যাংক তার আবেদনটি বিবেচনা করবে না এবং তার বিরুদ্ধে ঋণ আদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বা ইতিমধ্যে চলমান আইনগত ব্যবস্থা জোরদার করবে।
● আবেদনের সঙ্গে গ্রাহক যদি প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্টের টাকা এককালীন নগদ পরিশোধ করেন তবে ব্যাংক ৩ মাসের মধ্যে তার আবেদনটি বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। যে ক্ষেত্রে গ্রাহক পে-অর্ডার বা চেকের মাধ্যমে ডাউন পেমেন্টের টাকা জমা দিবেন সে ক্ষেত্রে ব্যাংক সেগুলোর নগদায়ন নিশ্চিত হওয়ার পরই পুন:তফসিল প্রক্রিয়াকরণের কার্যক্রম শুরু করবে। সময়ে সময়ে আংশিক আকারে পূর্বতন কোন জমা ডাউন পেমেন্ট হিসাবে বিবেচ্য হবে না।
● পুন:তফসিলকালে ব্যাংক গ্রাহকের অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা বিবেচনায় এনে গ্রাহকের ঋণ পরিশোধ সামর্থ্য যাচাই করবে।
● ব্যাংককে গ্রাহকের ক্যাশ ফ্লো ও সমুদয় আর্থিক বিবরণী পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে নিশ্চিত হতে হবে যে গ্রাহক পুন:তফসিলকৃত কিস্তি/বিদ্যমান দায় পরিশোধে সমর্থ্য কিনা!
● ব্যাংক কর্মকর্তারা প্রয়োজনে গ্রাহকের ব্যবসা/কারখানা সরেজমিনে পরিদর্শন করে নিশ্চিত হবেন যে গ্রাহকের ব্যবসার অর্জিত আয় থেকে গ্রাহক পুন:তফসিলকৃত ঋণের কিস্তি ও সমুদয় দায় পরিশোধ করতে সক্ষম। ব্যাংক শাখা পরিদর্শন প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্সপেকশনের জন্য যথাযথ ভাবে সংরক্ষন করবে।
● উপরোক্ত নির্দেশনাবলীর আলোকে যথাযথ যাচাই বাছাইপূর্বক গ্রাহকের আবেদন বিবেচনার জন্য সন্তোসজনক হলে ব্যাংক পুন:তফসিল কার্যক্রম গ্রহণ করবে। অন্যথায় ব্যাংক ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে আইনগত ভ্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং শ্রেণিকৃত দায়ের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করবে।
● যে কোন ঋণ পুন:তফসিলের সপক্ষে ব্যাংকের ক্রেডিট কমিটির লিখিত যৌক্তিকতা থাকতে হবে। যৌক্তিকতায় সংশ্লিষ্ট পুন:তফসিলটি ব্যাংকের দীর্ঘ মেয়াদি মুনাফায় ও মূলধন পর্যাপ্ততায় অনুকুল প্রভাব ফেলবে এবং ক্রেডিট কমিটির বিশ্বাস যে এই প্রক্রিয়ায় সম্পুর্ণ দায়টি পরিশোধিত হয়ে যাবে - এ মর্মে বিবৃতি দিতে হবে। এছাড়াও ব্যাংকের তারল্যের অবস্থা ও অন্যান্য গ্রাহকদের প্রয়োজনের বিষয়টিও বিবৃতিতে উপস্থাপন করতে হবে।
পুন:তফসিলের সময় সীমা
পুন:তফসিলের সময় সীমা বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৩.০৯.২০১২ তারিখের সার্কুলার নং-১৫ এবং মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে সংশোধিত সার্কুলার নং ০৬ তারিখ ২৯.০৫.২০১৩ নির্ধারিত হবে। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে সার্কুলারে বর্ণিত সময়সীমা সর্বোচ্চ সময়সীমা হিসাবে বিবেচ্য হবে। প্রতিটি প্রস্তাবের আলাদা আলাদা গুনগত মানের (Merit) ভিত্তিতে পুন:তফসিলের সময়সীমা নির্ধারিত হবে যা কোনক্রমেই সার্কুলারের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করবে না এবং কোন দায় তিন বারের বেশি পুন:তফসিল করা যাবে না।
কতিপয় বিশেষ অবস্থায় কৌশলগত কার্যক্রম গ্রহণ
১। কতিপয় বিশেষ অবস্থায় দেখা যায় খেলাপি গ্রাহক তার নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বাহ্যিক কারণে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন এবং তার বর্তমান ক্যাশ ফ্লো বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত পুন:তফসিলের সর্বোচ্চ সময়সীমার মধ্যে মাসিক কিস্তিতে সমুদয় খেলাপি দায় পরিশোধের জন্য যথেষ্ট নয়, সেক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে ব্যাংকের স¦ার্থে খেলাপি ঋণ নিয়মিতকরণ/আদায় বা পরিশোধে গ্রাহককে সহায়তা করার জন্য নিম্মোক্ত কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে -
ব্যাংক অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সুবিবেচনার সঙ্গে গ্রাহকের ব্যবসার বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, বিক্রয়ের পরিমাণ, বর্তমান ক্যাশ ফ্লো, অনুমিত ক্যাশ ফ্লো, ব্যবসার গতি প্রকৃতি, বাজার ও সংশ্লিষ্ট শিল্পের সার্বিক অবস্থা পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিচার বিশ্লেষনের পর যদি মনে করে গ্রাহককে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত সর্বোচ্চ সময়েরও অতিরিক্ত বাস্তব অবস্থার নিরিখে যুক্তিসঙ্গত বর্ধিত সময় দিলে গ্রাহক তার ব্যবসায় সামলে উঠতে পারবে এবং ব্যাংকের পাওনা পরিশোধে সক্ষম হবে।
একটি উদাহরণের সাহায্যে উল্লেখিত পরিস্থিতি পরিস্কার করা যেতে পারে - ধরা যাক,একজন তৈরি পোশাক রফতানিকারক বিশ্বব্যাপি বিস্তৃত ভয়াবহ কোভিড-১৯ এর কারণে তৈরি পোশাক যথাসময়ে রফতানি করতে ব্যর্থ হন। ক্রেতা রফতানি আদেশ বাতিল করে দেন। অন্যদিকে, ব্যাংককে বিপুল অংকের আমদানি বিলের অর্থ মেয়াদ পূর্তিতে গ্রাহকের পক্ষে ফোর্স লোন বা তলবি ঋণ সৃষ্টি করে পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। বর্ণিত অবস্থায় গ্রাহক এক চরম আর্থিক বিপর্যয়ে পতিত হয়েছেন। সব দু:সময়েরও এক সময় অবসান হয়। বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত কোভিডের ভয়াবহতা হ্রাস পেয়েছে। মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে। নুতন করে প্রচুর রফতানি আদেশ আসা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় উপরোক্ত গ্রাহককে স্টক লট রফতানি ও পুরাপুরি রফতানি শুরু করার লক্ষ্যে নুতন রফতানি আদেশ সংগ্রহ করে রফতানি সম্পন্ন করে রফতানি মূল্য পেতে পেতে প্রায় ৫/৬ মাস সময় লেগে যাবে।
এ অবস্থায় রফতানিকারক গ্রাহকের ঋণ পরিশোধ/নিয়মিত করণের আবেদনটি বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্যাংক প্রয়োজনীয় ডাউন পেমেন্ট গ্রহণ পূর্বক প্রস্তাবটি প্রক্রিয়াকরণ করে ক্রেডিট/ইনভেস্টমেন্ট কমিটির সুপারিশসহ পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের পুন:তফসিলের সম্ভাব্য রূপরেখা নিম্মরূপ হতে পারে -
(i) গ্রাহক নুতন এলসি সংগ্রহ করে ক্রমান্বয়ে ৩ বছরের মধ্যে সমুদয় স্টক লটের মালামাল রফতানি পূর্বক তলবি ঋণের দায় পরিশোধ করবেন ;
(ii) গ্রাহক ৬ মাস রেয়াতি সময় বাদে ১২টি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে তলবি দায় সমন্বয় করবেন - প্রাথমিকভাবে এলসি সংগ্রহ করে রপ্তানি সম্পাদনপূর্বক রপ্তানি আয় প্রত্যাবসিত হতে ৫/৬ মাস সময় লেগে যেতে পারে)।
(iii) সমুদয় স্টক লট রপ্তানির পরও যদি মালামালের মূল্য হ্রাস ও সুদ আরোপের ফলে তলবি ঋণের দায় বকেয়া রয়ে যায় তবে অবশিষ্ট দায় গ্রাহক তার স্বাভাবিক চলমান প্রতিটি প্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয় থেকে এক বছরের মধ্যে পরিশোধের শর্তে আনুপাতিক হারে জমা করবেন ;
(iv) গ্রাহকের ব্যাক টু ব্যাক এলসি সীমায় তলবি ঋণের দায়ও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। স্টক লট রপ্তানির মাধ্যমে দায় সমন্বয়ের পর লিমিটে যতটুকু সংস্থান বা স্থিতি থাকবে সে পরিমান এলসি খোলা যাবে।
এ ধরণের বিশেষ ক্ষেত্রে গৃহীত সিদ্ধান্ত আটকে পড়া ঋণ আদায়ের স্বার্থে পর্ষদ কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর করার অনুমোদন দেয়া যেতে পারে।
২. যে ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা তার ব্যবসায় বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন বা শারিরীক অসুস্থতার কারণে ব্যবসা চালাতে সম্পুর্ণ অক্ষম হয়ে ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন সে ক্ষেত্রে পুন:তফসিল পদ্ধতি যুক্তিসংগত হবে না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক বিআরপিডি সার্কুলার নং - ০৫ তারিখ মে ১৬,২০১৯ এ এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা অনুসরণ করে সম্পুর্ণ ঋণ পরিশোধের কার্যক্রম গ্রহণ করবে। এখানে এ বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য যে, ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকের নগদ উৎস থেকে এককালীন এক্সিট মোতাবেক ৩৬০ দিনের মধ্যে সম্পুর্ণ বকেয়া পরিশোধের সামর্থ্য নাও থাকতে পারে। এ অবস্থায় ব্যাংক নিম্মোক্ত কার্যক্রম গ্রহণ করবে -
(i) ব্যাংকের নিকট দায়বদ্ধ গ্রাহকের নিয়ন্ত্রাধীন মালামাল ও মেশিনারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে।
(রর) ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে দায়বদ্ধ প্লেজের মালামাল (যদি থাকে) যথাযথ আছে কিনা তা নিশ্চিত করবে। (ররর) ব্যাংকের অনুকুলে বন্ধকীকৃত অস্থাবর সম্পত্তি জায়গা জমি স্থাপনা ইত্যাদির দলিলাদিও সঠিকতা নিশ্চিত করবে।
(ii) ব্যাংক কর্মকর্তা ও তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরেজমিনে পরিদর্শন পূর্বক উপরোক্ত অস্থাবর ও স্থাবর সম্পত্তির বাজার মূল্য ও হ্রাসকৃত মূল্য (--) নির্ণয় করবে :
(iii) অতপর সমুদয় সম্পত্তি ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বিক্রিপূর্বক বিক্রয়লব্ধ অর্থ ঋণ হিসাবে জমার জন্য গ্রাহককে অনুমতি প্রদান করবে । মনে রাখতে হবে যে , বিক্রয় মূল্য কোন অবস্থাতেই হ্রাসকৃত মূল্যের কম না হয়।
(iv) বিক্রয়লব্ধ অর্থ দ্বারা ঋণ পরিশোধের পর যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে তা গ্রাহকের হিসাবে জমার মাধ্যমে ফেরত দিতে হবে। উপরোক্ত সমস্ত কার্যক্রম ৩৬০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করে এককালীন এক্সিট সুবিধা গ্রহণ করতে হবে।
৩. অনেক ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা হঠাৎ মৃত্যুবরন করেন বা পাগল হয়ে যান বা ব্যবসা ও পরিবার ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান এবং সংগত কারণেই গ্রাহকের অবর্তমানে ঋণ বিরূপ শ্রেণিকৃত হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে গ্রাহকের ওয়ারিশগণ যদি এগিয়ে আসেন এবং ব্যাংক যদি এই মর্মে সন্তোষ্ট হন যে গ্রাহকের ওয়ারিশগণ গ্রাহকের অবর্তমানে ব্যবসা পরিচালনার যোগ্যতা রাখেন, পরিবারের পর্যাপ্ত প্রকৃত সম্পদ রয়েছে এবং ঋণের দায় সহায়ক জামানত দ্বারা সম্পুর্ণ আবৃত ও ঝুকিমুক্ত সেক্ষেত্রে ব্যাংক বিরূপ শ্রেনিকৃত দায় বিআরপিডি সার্কুলারের নির্দেশনা মোতাবেক পুন:তফসিল করে ওয়ারিশগণদের নির্বাচিত প্রতিনিধিকে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দিতে পারে। তবে মালিকানা হস্তান্তরসহ পুরো কার্যক্রম একজন অভিজ্ঞ আইনজীবির তত্ত্বাবধানে সম্পাদন করতে হবে।
যে ক্ষেত্রে গ্রাহকের ওয়ারিশগণ ব্যবসা অব্যহত রাখতে/চালিয়ে যেতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন সে ক্ষেত্রে পুন:তফসিলকরণ যুক্তিযুক্ত হবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যাংক গ্রাহকের ওয়ারিশগণকে বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রি বা অন্য কোন উৎস থেকে ব্যাংকের বকেয়া পরিশোধের পরামর্শ দিবে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে ব্যাংক সার্বিক বিষয়াবলী সহাভ’তির সঙ্গে বিবেচনা করে বিরাজিত দায় থেকে আংশিক সুদ/মুনাফা মওকুফ করে এক্সিট পলিসির আওতায় খেলাপি দায়টি আদায়ের ব্যবস্থা করতে পারে।
৪. ঋণগ্রহীতার ব্যবসা নজিরবিহীন বন্যায় বা হঠাৎ ভয়াবহ আগুনে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে সম্পূর্ণ অপারগ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ঋণের দায়কে সম্পূর্ণ ব্লক করে রেয়াতি সময়সহ ঋণ হিসাবটিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পুূন:তফসিল করা যেতে পারে। পুন:তফসিলকালে যে কিস্তি নির্ধারণ করা হবে তা মাসিক না করে ত্রৈমাসিক বেলোনিং (ballooning) পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া গ্রাহককে পুনরায় ব্যবসা করার সুযোগ স¦রূপ নুতন করে সহজ শর্তে চলতি মূলধন ঋণ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। এসবই প্রযোজ্য হবে একজন পূর্ব পরীক্ষিীত উত্তম গ্রাহকের ক্ষেত্রে এবং যে ক্ষেত্রে নুতন ভাবে মঞ্জুরীতব্য চলতি মূলধনসহ সমুদয় দায় সহযোগী জামানত দ্বারা পরিপুর্ণভাবে আবরিত বা ব্যাংক যদি বিশ্বাস করে যে এভাবে সহযোগীতা পেলে গ্রাহক ব্যবসায় ঘুরে দাড়াতে পারবে। উপরোক্ত সমুদয় সুবিধা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের ব্যবসার উপর ব্যাংকের নিবিড় মনিটরিংও বজায় রাখতে হবে।
ইচ্ছাকৃত বা অভ্যাসগত ঋণখেলাপি (Artificial/Willful/Habitual defaulter)
ইচ্ছাকৃত বা অভ্যাসগত ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে ব্যাংক নিম্মোক্ত দু’টি অবস্থার মুখোমুখি হয় -
(i) খেলাপি ঋণগ্রহীতা তার বিরূপ শ্রেণীকৃত ঋণ/দায় যা সে ব্যবসায় ব্যবহার না করে অপব্যবহার করেছে বা অসৎ উদ্দেশ্যে অন্যত্র সরিয়ে ফেলেছে তা পুন:তফসিল করার জন্য প্রস্তাব দিবে। এই শ্রেনির ঋণখেলাপিরা মূলত: বিভিন্ন কায়দা কানুনে ঋণ পরিশোধ দীর্ঘায়িত করে ঋণ পরিশোধ এড়িয়ে চলে। এদের অনেকেই আবার বিশিষ্ট ব্যাংকার জনাব ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের (বর্তমানে রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের এমডি ও সিইও) ভাষায় ‘ ঋণ পর্যটক’। এ ব্যাংকের মঞ্জুরীকৃত ঋণ দ্বারা অন্য ব্যাংকের খেলাপি দায় শোধ করে বা অন্য ব্যাংকের খেলাপি দায় অধিগ্রহণের (Take over) ব্যবস্থা করে সাময়িক ভাবে ঋণ পরিশোধের চাপ এড়ায়।
(ii) দ্বিতীয় শ্রেণির ঋণ খেলাপিরা ব্যাংকের সঙ্গে কোন যোগাযোগ বা সহযোগিতা করবে না। এদের অধিকাংশই সাধারণত: সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী মানুষ। এরা শুরুতেই অনৈতিকভাবে প্রভাব খাটিয়ে ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে ঋণ হাতিয়ে নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋণের বিপরীতে যে সব জামানত প্রদান করে তার বেশির ভাগই ভূয়া বা নিন্মমানের যা গৃহীত ঋণের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। জামানত স্বরূপ যে সকল অস্থাবর ভূসম্পত্তির বন্ধকি সম্পাদন করে সেগুলোর বেশির ভাগই রাস্তা-ঘাটের সংযোগবিহীন নিচু জলাভমি। ব্যাংক কর্মকর্তাদের পরিদর্শনকালে এরা তাদের অসতর্কতা ও অদক্ষতার সুযোগে অন্যের ভাল জমিকে নিজের জমি বলে চালিয়ে দেয়। এছাড়াও সার্ভে কোম্পানি ও কতিপয় অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজসে এসব সম্পত্তির অতি মূল্যায়ন প্রদর্শন করে প্রস্তাবনায় ঋণকে জামানত দ্বারা আবরিত দেখান হয়। আবার আরো স্মার্ট ঋণ প্রতারকরা শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরা শিল্পের মেশিনারীর কয়েকগুণ অধি-উদ্ধৃবায়ন (Over Invoicing) দেখিয়ে পরবর্তীতে আমদানিকৃত মেশিনারীর মূল্য পরিশোধের নামে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করে। অনেক ক্ষেত্রে মেশিনারীর বদলে স্ক্রাপ আসে। শিল্প আর ্রপ্রতিষ্ঠিত হয় না এবং ইতিমধ্যে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ায় উদ্যোক্তার আর এ ব্যাপারে আগ্রহও থাকে না। এভাবে এসব ঋণ খেলাপিরা ঋণের পুরো টাকাটাই আতœসাৎ করে। অনেক সময় এরা বিদেশে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এসব প্রতারক/ফেরারি ঋণখেলাপিরা স্বভাবতই কখনই ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসবে না এবং ব্যাংককে সহযোগিতা করবে না।
উপরের ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত ঋণখেলাপির ক্ষেত্রে ব্যাংক যদি যথাযথ পর্যালোচনার পর নিশ্চিত হয় যে, ঋণের টাকার অপব্যবহার বা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়াই গ্রাহকের ঋণখেলাপের পশ্চাতে মূল কারণ, সেক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ খেলাপির পুন:তফসিলের আবেদন বিবেচনা না করে গ্রাহককে সমুদয় দায় পরিশোধের জন্য জোর তাগিদ প্রদান করবে এবং ব্যর্থতায় তার বিরুদ্ধে সব রকম আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
‘খ’ শ্রেণির প্রভাবশালী মূলত: প্রতারক ও ধুরন্দর স্বভাবের ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ব্যাংক ফৌজদারীসহ সব ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।এখানে ইচ্ছাকৃত প্রভাবশালী ও অভ্যাসগত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপের নিয়মাচার ও পদক্ষেপ সমূহ সংক্ষেপে আলোচিত হলো:
(i) হালনাগাদ সমুদয় দায় পরিশোধের জন্য পুন: পুন: কয়েকটি তাগিদ পত্র গ্রাহকের সর্বশেষ ঠিকানায় প্রেরণ ;
(ii) ব্যাংক কর্মকর্তাদের (মহিলা কর্মকর্তা থাকা বাঞ্ছনীয়) দলবল সহ ঋণগ্রহিতার অফিসে ও বাসায় গমন যাতে খেলাপি গ্রাহকের অপকীর্তিসমুহ জনসম্মুখে প্রকাশ হয় বা গ্র্রাহক বিব্রত বোধ করে এবং পারিবারিকভাবে ও সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়। এ শোভাযাত্রা বেশ কয়েক দফা করতে হবে।
এভাবে সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর ব্যাংক পরিশেষে আ্ইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ লক্ষ্যে ব্যাংক ঋণখেলাপিকে চুড়ান্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে(ধরা যাক ১৫ দিন) খেলাপি দায় পরিশোধের জন্য চুড়ান্তভাবে তাগিদ দিবে। বিজ্ঞপ্তিতে পূর্বের পুন: পুন: তাগিদ পত্রের বিবরণের উল্লেখ করে চুড়ান্ত বিজ্ঞপ্তির নির্দেশ মোতাবেক সমুদয় বকেয়া পরিশোধ না করলে আর কোন যোগাযোগ ব্যতিরেকেই ঋণ আদায়ের লক্ষ্যে খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ইঙ্গিত প্রদান করা হবে। মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে মাসিক/ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ্য ঋণের কিস্তি খেলাপির কারণে ঋণ বিরূপ শ্রেনিকৃত হলে চুড়ান্ত বিজ্ঞপ্তিতে ঋণখেলাপিকে সমুদয় দেনা/দায় পরিশোধের তাগিদ প্রদান করে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
ঋণখেলাপি ও ঋণ খেলাপের প্রকৃতি অনুসারে ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে ফৌজদারি, এন আই এ্যাক্ট (N.I.Act) ও অর্থ ঋণ আদালত আইন-২০০৩ এর আওতায় মামলা করা যাবে। ইচ্ছাকৃত/অভ্যাসগত খেলাপিরা সমাজের অত্যন্ত প্রভাবশালী দুষ্ট প্রকৃতির লোক। এদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। অন্যথায় অন্যান্য ঋণগ্রহিতার মাঝেও ঋণ খেলাপের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ‘ব্যাধিই ছড়ায়, স্বাস্থ্য না।’ এদের কারণে ইতোমধ্যে ব্যাংক ও আর্থিক সেক্টরে এক ভয়াবহ ঋণ খেলাপ সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে।
Negotiable Instruments Act,1881 এর আওতায় মামলা দায়ের
ব্যাংক সর্বপ্রথম Negotiable Instruments Act,1881 এর আওতায় মামলা দায়েরের কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
ব্যাংক বিতরণকৃত ঋনের বিপরীতে জামানত হিসাবে ঋণগ্রহিতার চেক নিয়ে থাকে। মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে প্রতিটি কিস্তির জন্য একটি করে চেক নেয়া হয়। এই সব চেকের প্রতিশ্রুত অর্থ পরিশোধের জন্য ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে যথারীতি চেক উপস্থাপন করবে। চেক ডিস্অনার হলে মামলা দায়েরের পূর্বে Negotiable Instruments Act,1881 এর ধারা ১৩৮-১৪১ এ বর্ণিত বিধানাবলী অনুসরণে নিম্মোক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে:
- ব্যাংক তালিকাভূক্ত আইনজীবির মাধ্যমে Negotiable Instruments Act,1881 এর ১৩৮ ধারার বিধান মোতাবেক ৩০ দিনের মধ্যে চেকের টাকা পরিশোধের জন্য চেকদাতাকে নোটিশ দিবে ;
- অত:পর ঐ সময়ের মধ্যে চেক দাতা টাকা পরিশোধ না করলে উহার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে চেক গ্রহীতাকে এখতিয়ারসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে নালিশী মামলা দায়ের করতে হবে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ব্যাংককে বেশ কিছু চেক ডিস্অনার করিয়ে চেক দাতা ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে প্রতি সপ্তাহ পর পর একটা করে বেশ কয়েকটা মামলা দায়ের করতে হবে যাতে তাকে ঘন ঘন আদালতে হাজিরা দিতে হয় এবং মাসের অধিকাংশ সময়ই আদালত পাড়ায় সময় কাটাতে হয় যা তার জন্য হবে অত্যন্ত অস্বস্থিকর ও অবমাননাকর।
অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩ এর অধীনে মামলা দায়ের
অর্থঋণ আদালত আইন- ২০০৩ এর অধীনে মামলা দায়েরের লক্ষ্যে ব্যাংককে নিম্মোক্ত পদক্ষেপ গুলো অনুসরণ করতে হবে :
১. অর্থঋণ আদলত আইন ২০০৩ এর ধারা ১২(১) ও (২) এর বিধান মোতাবেক ব্যাংক তার নিয়ন্ত্রণ বা দখলে থাকা ঋণখেলাপির কোন সম্পত্তি যা পণ বা বন্ধক ((lien or pledge) রেখে ঋণ প্রদান করা হয়েছে এবং যা বিক্রয় করার আইনগত অধিকার ব্যাংকের রয়েছে তা নিলাম বিক্রয় পূর্বক বিক্রয়লব্ধ অর্থ ঋণ হিসাবে সমন্বয় করবে।
২. ব্যাংক ঋণখেলাপির নিকট থেকে কোন স্থাবর সম্পত্তি (Immoveable Property) বন্ধক (Mortgage) রেখে অথবা অস্থাবর সম্পত্তি (Moveable Property ) দায়বদ্ধ রেখে ঋণ প্রদান করলে এবং বন্ধক প্রদান বা দায়বদ্ধ রাখার সময় বন্ধকি বা দায়বদ্ধ সম্পত্তি বিক্রয়ের ক্ষমতা ব্যাংককে প্রদান করা হয়েছে, ব্যাংক উক্ত সম্পত্তি এই আইনের ১২(৩) ধারা মোতাবেক বিক্রয় করে ঋণ হিসাবে সমন্বয় করবে।
৩. উপরোক্ত সম্পত্তি সমূহ বিক্রয়ের লক্ষ্যে ব্যাংক অন্যূন ১৫(পনের) দিন সময় দিয়ে সীলমোহরকৃত টেন্ডার আহ্বান করবে। উক্ত বিজ্ঞপ্তি কমপক্ষে বহুল প্রচারিত একটি বাংলা জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ও একটি স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশ করবে। অন্যদিকে, ব্যাংক দরপত্রে অংশগ্রহণ করে সম্পত্তি/সম্পত্তি সমূহ ক্রয়ে আগ্রহীী এমন একজন সম্বাবনাময় দরদাতা যোগাড়ের প্রচেষ্ট গ্রহণ করবে।
৪. উপরোক্ত ধারা ১২(৩) এ উল্লেখিত বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক এই আইনের ধারা ৩৩-এর উপ-ধারা (১), (২) ও (৩) এর বিধান ,যতদুর সম্ভব, অনুসরণ করবে।
৫. সম্পত্তির নিলাম বিক্রয়কালে ব্যাংককে খেয়াল রাখতে হবে য়ে,দাখিলকৃত দরপত্রে সম্পত্তির প্রস্তাবিত মূল্য অস্বাভাবিকভাবে অপর্যাপ্ত বা কম তবে ব্যাংক উক্ত দরপত্র বাতিল করবে এবং সম্ভাবনাময় ক্রেতা কর্তৃক উপযুক্ত মূল্যে দরপত্র দাখিল করবে এমন নিশ্চিত হয়ে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করবে। উল্লেখ্য যে, দরপত্র আহ্বানের পূর্বে ব্যাংক তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ার ও ব্যাংকের দক্ষ কর্মকর্তা দ্বারা নিলামের জন্য নির্বাচিত সম্পত্তি/ সম্পত্তিসমূহের প্রকৃত মূল্য নির্ণয় করবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক দরপত্রে অংশগ্রহণকারী সম্ভাব্য ক্রেতাকেও নিলাম বিক্রয়তব্য সম্পত্তি/সম্পত্তিসমূহ পরিদর্শনসহ সব রকম সহয়োগিতা করবে।
৬. নিলামে সর্বোচ্চ দরদাতাকে অবিলম্বে অবশিষ্ট অর্থ পরিশোধের পর ব্যাংক সম্পত্তি রেজিষ্ট্রশনসহ দখল বুঝিয়ে দিবে। এইক্ষেত্রে বন্ধক দাতা ঋণ খেলাপীকে লিখিতভাবে ক্রেতাকে দখল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করবে। যদি বন্ধকদাতা দখল বুঝিয়ে না দেয় এবং সম্পত্তি দখলমুক্ত না করে দেয় তবে ব্যাংক জেলা ম্যাজিষ্টেটকে উক্ত সম্পত্তি দখল মুক্ত করে ক্রেতাকে দখল প্রদানের অনুরোধ করবে। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট বা যে কোন প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিষ্ট্রেট ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে বন্ধকীকৃত/প্লেজকৃত সম্পত্তি/মালামালের সঠিকতার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে সম্পত্তি/মালামাল নতুন ক্রেতাকে নিলামে নির্বাচিত ক্রেতা বা ব্যাংককে দখল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সকল প্রশাসনিকভাবে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
৭. ব্যাংক নিলামে বিক্রয়লব্ধ সমুদয় মূল্য ঋণ হিসাবে সমন্বয় করবে। এই ক্ষেত্রে ব্যাংক দুইটি কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।
(ক) যদি নিলাম বিক্রয় অর্থ দ্বারা ঋণ হিসাব সমন্বয় না হয় তবে অবশিষ্ট অনাদায়ী টাকার আদায়ের জন্য ঋণ খেলাপীর বিরদ্ধে অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩ এর অধীনে মামলা দায়ের করবে।
(খ) যদি সমুদয় পাওনা পরিশোধের পর অতিরিক্ত টাকা থেকে যায় তবে তা গ্রাহকের চলতি হিসাবে জমা করে দিবে ।
৮. মামলা দায়েরের পরও ঋণ খেলাপীর সংগে ব্যাংক সমঝোতা চুক্তি করতে পারে। উক্ত চুক্তি অনুসারে ঋণ গ্রহীতা যদি ব্যাংক কর্তৃক আরোপিত প্রয়োজনীয় শর্ত সাপেক্ষে ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসে তবে ব্যাংক তার সংগে একটি সোলেনামা সম্পাদন করবে এবং তা আদালতে অনুমোদনের জন্য দাখিল করবে।
৯. ব্যাংক যদি নিলাম বিক্রয়ে ব্যর্থ হয় তবে ঋণ তামাদি হওয়ার পূর্বে অবিলম্বে মামলা দায়ের করবে। এক্ষেত্রে আদালত স্ব-উদ্দ্যোগে অথবা দায়িকের লিখিত আবেদনক্রমে, ডিক্রি প্রদান করবার সময় ব্যাংক কর্তৃক উক্ত সম্পত্তির প্রদর্শিত মূল্যায়নে (যদি থাকে) সমপরিমাণ অর্থ মামলার দাবী থেকে বাদ দিয়ে ডিক্রি প্রদান করবে। যদি প্রদর্শিত মূল্য না খাকে তবে আদালত সম্পত্তির স্থানীয় অধীক্ষেত্রে সব-রেজিষ্ট্রেরারের প্রতিবেদন গ্রহণ করে মূল্য নির্ধারণ করবে এবং নির্ধারিত উক্ত মূল্যের সমপরিমান অর্থ মামলার দাবী থেকে বাদ দিয়ে ডিক্রি প্রদান করবে। অর্খঋণ আদালত আইন-২০০৩ এর ১২(৮) ধারা অনুসারে অন্য কোন আইনে ভিন্নরুপ যা কিছু থাকুক না কেন, এই ধারার অধীন আর্থিক প্রতিষ্টান কর্তৃক লিয়েন প্লেজ/হাইপোথিকেশন অথবা মর্টগেজের অধীনপ্রাপ্ত ক্ষমতা বলে কোন জামানতীর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করা হলে, উক্ত বিক্রয় ক্রেতার অনুকুলে বৈধ শত্য সৃষ্টি করবে এবং ক্রেতার ক্রয়কে কোনভাবেই তর্কিত করা যাবে না । তবে শর্ত থাকে যে ব্যাংক কর্তৃক বিক্রয় কার্যক্রমের কোনরূপ অবৈধতা বা পদ্ধতিগত অনিয়ম থাকলে জামানত প্রদানকারী ঋণ গ্রহীতা ব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারবেন।
ফৌজদারী মামলা দায়ের
ঋণ গ্রহীতা ঋণ গ্রহণকালে মিথ্যা তথ্য, ভূয়া জামানত প্রদান, মেশিনারীর ওভার ইনভয়েসিং করে অর্থ পাচারসহ অন্যান্য ফৌজদারী অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে তার এসব অপরাধমূলক কর্মকান্ড দূনীর্তি দমন ব্যুারো কর্তৃক তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
লেখক অর্থনীতিবিদ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এর সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিয়মিত লেখক
ihsanul1919@gmail.com
#
অকা/নিলে/রাত, ৩ জুন, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 years আগে

