বিশ্বাস বিকাশ ●
আমাদের দেশে একসময় হাওড় ও বিল অঞ্চলে ছিটানো আউশ ও আমন ধানের চাষ হতো। এক চাষে দু’ ফসল! ভাবা যায়? ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আমাদের অঞ্চলে আমি এই মিশ্র ধানের চাষ দেখেছি। বয়স্কদের মুখে দেশের পুরো বিল ও হাওড় অঞ্চলে মিশ্র ধান চাষের গল্প শুনেছি। এক বছর চাষ হলে ৫ বছর আর ফসলের প্রয়োজন হতো না! পর পর দু’ বছর ফসল হলে ধানের গোলায় কালচে রং ধরতো। অথচ এখন কেউ এর খবর রাখে না। সবাই ভুলে বসে আছে! ইরি-বোর ধানের দাপটে পুরো দেশ থেকেই মিশ্র ধানের আবাদ বিলীন হয়ে গেছে। সঙ্গে সরিষা, মুগ, তিল চাষও উধাও! দেশে ভোজ্য তেল এখন ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। কারণ, যে সময় রবি শস্য চাষ হয়, সে সময় ইরি-বোর চাষের কারণে বিল ও হাওড় অঞ্চলে সরিষা, মুগ, তিল চাষের জন্য জমি খালি পাওয়া যায় না। দু’ ফসলি জমি এখন এক ফসলি!
এবার মূল কথায় আসি। ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে পুরো চৈত্র মাস জুড়ে চলতো বীজ বপনের কাজ। প্রথমে লাঙ্গলের চাষ দিয়ে দিন পনের জমি শুকানো হতো। দ্বিতীয় চাষ দিয়ে আউশ ও আমন ধানের আনুপাতিক মিশ্র বীজ হাতের আন্দাজে পুরো জমিতে ছিটিয়ে দেয়া হতো। তারপর মই দিয়ে বীজগুলো ঢেকে দিত। ব্যাস! ওই পর্যন্তই! বাড়তি আর কোন কিছু নয়! ইউরিয়া, ফসফেট, পটাশ কোন সারই প্রয়োগ হতো না। ওতেই সারা ক্ষেত জুড়ে বীজ অঙ্কুরোদ্গম হতো। পৌষে জমিতে নাড়া পুড়ে এবং কখনও গোবর সার দিয়ে জমির উর্বরতা বাড়ানো হতো। কাল বৈশাখীর সুবাদে বৃষ্টিস্নাত ক্ষেতের ধান গাছ ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা হলে বৈশাখের মাঝামাঝি থেকে ক্ষেতে নিড়ানি দেয়া হতো। কোন সেচের প্রয়োজন হতো না। পুরোটাই প্রকৃতি নির্ভর ছিল। জ্যৈষ্ঠের শুরুতেই নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে খাল-নালা উপচে ক্ষেতে পানি প্রবেশ করতে শুরু করতো। ধান গাছগুলোও পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঊর্ধ্বমুখে ছুটে চলতো। কোনভাবেই পানির তোড়ে যেন ধান গাছগুলো তলিয়ে না যায়! বরং নিরাপদ উচ্চতায় গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো। ইতোমধ্যে গাছের ঊর্ধ্ব ও মধ্য ডগা থেকে শাখা-প্রশাখা গজিয়ে পুরো ক্ষেত সবুজে ছেয়ে যেতো। দুই-তিন ফুট পর পর গাছগুলোতে এক একটি গিট থেকে অসংখ্য ভাসমান মূল বের হয়ে গাছগুলোকে পানিতে ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করতো। ফলে ২০-২৫ ফুট পানিতেও গাছগুলোর দাঁড়িয়ে থাকতে কোনই সমস্যা হতো না। এ যেন ছিল ধান গাছগুলোর প্রতি প্রকৃতির অপার আশীর্বাদ!
আষাঢ়ে আউশ ধানের গাছগুলোতে থোড় আসা শুরু করত এবং শ্রাবণে ধান পাকতো। তখন গাছগুলো নিজের ভাসমান মূলের পাশাপাশি আমন গাছের ওপর ভর করে পাকা ধানগুলোকে পানিতে তলানো থেকে রক্ষা করতো। গৃহস্থরা কিষাণের সাহায্যে নৌকায় চড়ে ক্ষেত যেত। এরপর ধান কেটে বাড়ীর উঠোনে পালা দিয়ে রোদের অপেক্ষায় প্রহর গুনতো। বৃষ্টির বিরতির মাঝে রোদ উঠলে পায়ে বা গরু দিয়ে ধান মাড়াই করে শুকিয়ে গোলায় তুলতো। রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কবিতায় তরীভর্তি যে সোনার ধানের বর্ণনা পাওয়া যায়, তা এই আউশ ধানেরই রূপকল্প। কারণ, কুষ্টিয়ার কুমারখালিস্থ শিলাইদহ কুঠিবাড়ী, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরস্থ কুঠিবাড়ী এবং নওগাঁর পতিসরস্থ কুঠিবাড়ীর চতুর্দিক জলাভূমি বেষ্ঠিত বিলাঞ্চল যা এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলে এখনো শ্রাবণ-ভাদ্রে ১২-১৫ ফুট পর্যন্ত পানির গভীরতা থাকে যা অতীতে ২০ ফুট পর্যন্ত ছিল। আর এ থেকেই প্রমাণ হয় যে ঊনিশ-বিশ শতক জুড়ে আমাদের দেশের হাওড় ও বিলাঞ্চলে এই ছিটা আউশ-আমন ধানে চাষাবাদ হতো। ধানগুলো ছিল ক্ষুদ্র আকৃতির, তবে খেতে ছিল মিষ্টি ও সুস্বাদু। আউশ ধানের ঘন ভাত মাড়ের সঙ্গে ঘি মিশ্রিত আলু ভর্তা ছিল অমৃত সমান! আহা! যেন পুরোটাই মাখন! এই আউশ ধান দিয়েই পৌষ মাস পর্যন্ত গৃহস্থের খোরাকি চলতো এবং খড়-বিচালি গো-খাদ্যের যোগান দিতো। শ্রাবণ থেকে পৌষ এই ছ’ মাস বিলাঞ্চলে কোন খাদ্যাভাব ছিল না। বিলগুলোতে ছিল প্রচুর মাছের আধিক্য, যাকে বলে মাছে-ভাতে বাঙ্গালি। এই হাওড় ও বিলাঞ্চলে ছিল পুঠি, টেংরা, কই, শিং, পাবদা, সরপুঠি, শৌল, গজার, টাকি, মিনি, পটকা, চান্দা, কাইটলা, বাইম, কাঁকড়া, ইচাচিংড়ি, খলিসা, টাটকিনা আরো নাম অজানা নানাবিধ মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র যা আজ বিলুপ্ত প্রায়! এসব মাছ চাষের জন্য কোন মস্য খামার বা কৃত্রিম ফিডের প্রয়োজন হতো না, বরং জ্যৈষ্ঠ থেকে পৌষ এই ৭ মাস হাওড়-বিলের ধানক্ষেত গুলো ছিল মাছেরা অভয়ারণ্য এবং এখান থেকেই সমগ্র দেশের মাছের যোগান দেওয়া হতো। রুই-কাতলা ছিল তখন শখের মাছ যা পুকুরে চাষ হতো এবং মাঝে মধ্যে বড় আকারের রুই-কাতলা নদীতে পাওয়া যেত। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওড় অঞ্চল এবং ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, কুমিল্লার কিছু অংশ, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়ার পূর্বাঞ্চল, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ ও রাজশাহীর পূর্বদিকের বিলাঞ্চল মিলে দেশের এক ত্রিতীয়াংশ অঞ্চল ছিল এই ছিটা আউশ-আমন ধান চাষের উত্তম ক্ষেত্র ও মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য ভান্ডার।
আউশ ধান কাটার পর আমন গাছগুলো পুনরায় স্বমহিমায় সবুজের সমারোহ নিয়ে ফিরে আসতো। আর আউশ ধানের গাছগুলো ক্ষেতেই পচে জৈব সারের কাজ দিত। পুরো ভাদ্রমাস জুড়ে চলতো আমন ধানের গাছেগুলোর বাড়বাড়ন্ত। আশ্বিনের প্রথম থেকেই হিমালয়ের বরফ গলা থেমে গেলে নদীর পানিতে টান পড়তেই ক্ষেতের পানিও কমতে শুরু করতো। তখন ধান গাছগুলোও পানির সাথে তাল মিলিয়ে প্রথমে হাঁটু গেড়ে, তারপর কোমড় ভেঙ্গে ক্ষেতে বসে পড়তো। তবে স্বল্প পানিতেও পাতা ও কুঁড়ির মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে কোন সমস্যা হতো না। আশি^নের শেষ সপ্তাহ থেকে ধান গাছে থোড় আসতো এবং কার্তিকের শেষে ধান পাকতে শুরু করতো। পুরো অগ্রহায়ণ মাস জুড়ে চলতো ধান কাটা, মাড়াই ও নবান্ন উৎসবের আমেজ! সারা মাঠ জুড়ে সোনালী আভা দোল খেত বলেই কবিগুরুর অবাক বিষ্ময় আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে ফুটে উঠেছে! পৌষে ধান শুকিয়ে গৃহস্থরা গোলা ভরতো এবং পিঠে-পুলির উৎসবে মেতে উঠতো। সে কি আনন্দ! সারা বাংলা জুড়ে চলতো এই উৎসবের আবাহ! গৃহস্থরা শ্রাবণ-ভাদ্র মাস পর্যন্ত খোরাকি রেখে বাকিটা বিক্রি করে পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতো। পুরো ৯ মাসের এই অভিযাত্রায় খরচ ওই হালের লাঙ্গল, বলদ ও নিড়ানি মাত্র। ধানের বীজ গৃহস্তের ঘরেই থাকতো। বাকি তিন মাস রবি মৌসুমে চলতো সরিষা, তিল, মুগ, খেসারি, মটরশুটির চাষ। আর এসব রবি শস্যের কারণে জমির নাইট্রোজেনের মাত্রা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুষম থাকতো। পুরো বিল এলাকায় যে পরিমাণ সরিষা ও তিল উৎপন্ন হতো, তা দিয়ে সারা দেশের ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটতো, আমদানির প্রয়োজন হতো না। মুগ ও খেসাির ডালের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ছিল। প্রাকৃতিকভাবেই জমিগুলো দো’ ফসলি ছিল যা এখন এক ফসলি ইরি-বোরতে রূপান্তর হয়েছে। আর রবিশস্যেও যথেষ্ট আবাদ না থাকায় ৯০% ভোজ্য তেল আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে।
শুধু ধান ও রবি শস্যের মধ্যেই ছিটা আউশ-আমন ধানের গুরুত্ব এবং বিশেষত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল এক বিশাল মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য ভান্ডার। অর্থনৈতিক বিবেচনায় পুরো বিষয়টির গুরুত্ব অপরিসীম। বিবিএসের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুয়ায়ী ২০২২-২৩ অর্থ বছর শেষে জিডিপির আকার ৫০ লাখ ৪৮ হাজার ২৭ কোটি টাকা বা ৪৬০.২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ৫৯.৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ১২.৯১%। এর মধ্যে শস্যদানা ৭০% এবং মৎস্য ২৬.৩৭%। সে হিসেবে হাওড় ও বিল অঞ্চলের শস্যদানার অবদান ২৩.৩৩% অর্থাৎ ১৩.৮৬ বিলিয়ন ডলার। এককভাবে জিডিপিতে মাছের অবদান ৩.৫২%। ছিটা আউশ-আমন ধানের চাষাবাদ প্রচলিত থাকলে এই মুহূর্তে এখান থেকে ধান ও মাছ থেকে জিডিপিতে অবদান থাকতো ৭.৩০% {((১২.৯১/৩=৪.৩০)+৩)=৭.৩০} বা ৩৩.৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে ভোজ্য তেলের আমদানি ব্যয়ের অর্ধেক ৭.১৪ বিলিয়ন ডলার রবি শস্যেও অবদান হিসেবে যোগ হয়ে ছিটা আউশ-আমন অঞ্চলের জিডিপিতে অবদান হতো ৪০.৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আউশ-আমনের উফসি জাত উদ্ভাবিত হলে জিডিপিতে কৃষির অবদান অনায়াসে ২০% এ উন্নীত করা সম্ভবপর; যার মধ্যে হাওড় ও বিল অঞ্চলের অবদান হবে ১৪.৩৯% যা ৬৬.২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য যা দেশীয় মুদ্রায় ১২০ টাকা হিসাবে ৭ লাখ ৯৪ হাজার ৬ শ’ ৪০ কোটি টাকা ।
দেশের অর্থ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য বিভাগ একযোগে এই দিকটায় মনোযোগী হলে কৃষি অর্থনীতিতে লক্ষ্যে পৌঁছানো সময়ের ব্যাপার মাত্র। এটি সম্ভব হলে-
বাঁচবে পরিবেশ, বাঁচবে ডলার, বাঁচবে দেশ!
বাড়বে পুষ্টি, বাড়বে আয়ু, হবে সোনার বাংলাদেশ! ●
অকা/কৃখা/নিলে/দুপুর, ১ জুন, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ
লেখক বীমা ও পরিসংখ্যানবিদ
সর্বশেষ হালনাগাদ 11 months আগে
১ Comment
চমৎকার! লেখা। আমাদের জীবনের কথা উঠে এসেছে।