অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ অনেকের বক্তব্যেই ভারত বিরোধিতা ও এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানের ঘোষণা উঠে এসেছে। নাগরিক পর্যায়েও ভারতীয় পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর ডাক দিয়েছেন অনেকেই। যদিও দুই দেশের বাণিজ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রকৃতপক্ষে পণ্য আমদানিতে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা আরো বেড়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে ভারত থেকে আমদানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ।
ভারতে অর্থবছরের হিসাব শুরু হয় এপ্রিল থেকে। দেশটির শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ ভারতীয় অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (এপ্রিল-জানুয়ারি) বিশ্বব্যাপী ভারতের পণ্য রফতানির প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। যদিও এ সময় বাংলাদেশে ভারতের পণ্য রফতানি বা ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি বেড়েছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। আর গত জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী ভারতের পণ্য রফতানি সংকুচিত হয়েছে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ। যদিও একই সময়ে দেশটি থেকে বাংলাদেশে পণ্য রফতানি বেড়েছে ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ।
যদিও গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশে ভারত থেকে পণ্য আমদানি নিম্নমুখী হয়ে উঠেছিল। জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির প্রভাব পড়ে দুই দেশের বাণিজ্যে। টানা তিনদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ ছিল। আগস্টে ভারত থেকে আমদানি কমেছিল ১৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
একই সময়ে পেঁয়াজ, ডিম ও কাঁচামরিচের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারদরে দেখা দেয় বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা। দামের ঊর্ধ্বগতি সামাল দিতে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে এসব পণ্য আমদানি করা হয় বিপুল পরিমাণে। এর পর থেকেই পণ্য আমদানিতে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা আরো বেড়েছে।
ভারতীয় অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের অর্থমূল্য ছিল ৯৩৯ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার ডলার। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে জানুয়ারি সময়ে আমদানি হয়েছে ৮৮০ কোটি ৯৯ লাখ ডলারের পণ্য। শুধু গত জানুয়ারিতেই ভারত থেকে বাংলাদেশ পণ্য আমদানি করেছে ১০৭ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। আর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আমদানি হয়েছিল ৯১ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের।
ভারতের বাণিজ্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটি থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় তুলা। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে খাদ্যশস্য। এছাড়া আমদানি হয় খনিজ ও জ্বালানি পণ্য, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য পণ্য ও সেবা। আর বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি হওয়া প্রধান পণ্য হলো তৈরি পোশাক।
দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কের পরিসংখ্যানগত চিত্র মূল্যায়নে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি ও অধিকারকে উপেক্ষা করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নতজানু মানসিকতার কারণেই দুই দেশের সম্পর্কে এখন এ ধরনের বৈরিতা দেখা দিয়েছে। এ বৈরিতা এখন দুই দেশেই রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও বাণিজ্য পরিসংখ্যানগুলো বলছে, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশান জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, ‘দুই দেশের একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ আর বাণিজ্য পরিসংখ্যানে বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। সাধারণ জনগণের মধ্যে এ ধরনের চিন্তাভাবনা থাকবেই। কারণ ১৭ বছর তারা নিপীড়নের মধ্যে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই ভারতবিরোধী ধারণা বা মতবাদ তৈরি হয়েছে। সবাই চিন্তা করছে যে ভারতের জন্যই আমরা কষ্টের মধ্যে আছি। সেজন্য সাধারণ মানুষ ভারতবিরোধী কথা বলে। আগের শাসকগোষ্ঠীর প্রো-ইন্ডিয়ান কথাবার্তা মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তবে আনুষ্ঠানিক বিষয়গুলো, যেমন বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক চুক্তির মতো বিষয়গুলো, সেগুলো চলমান রয়েছে। এগুলো রাতারাতি বাদ দেয়া যায় না। বাজার পরিস্থিতি যাচাই করলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের বাজারগুলোয় ভারতীয় পণ্য বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাবও কিছুটা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। আবার প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে নির্ভরতা কিছুটা হলেও থাকবেই, এটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশের পরিস্থিতি যখন আরো স্বাভাবিক হবে, অর্থনৈতিক সম্পর্কের নির্ভরতাও থাকবে, পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ধারণাগত বৈরিতা ধীরে ধীরে কমে আসবে।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা ক্রমেই বাড়তে দেখা যাচ্ছে। তবে কয়েক বছর আগে শুল্ক বাড়িয়ে দেয়ায় দেশটি থেকে চাল আমদানি ব্যাহত হয়েছে দীর্ঘদিন। দেশটিতে চাল রফতানি শুল্ক কমিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে থাকে ব্যক্তি খাতের আমদানীকৃত ভারতীয় চাল। এরপর গত বছরের ৪ ও ১৮ ডিসেম্বরে দুই দফায় সরকারিভাবে মোট ১ লাখ টন নন-বাসমতী সিদ্ধ চাল আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। এর ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জি-টু-জির ভিত্তিতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আনা চাল বাংলাদেশে প্রবেশ করা শুরু হয় গত ২৬ ডিসেম্বর। এরপর জানুয়ারির মাঝামাঝি দেশটি থেকে আরো ৫০ হাজার টন চাল সরকারিভাবে আমদানির অনুমোদন দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি দেশটি থেকে আরো ৫০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয় সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। একই সঙ্গে অব্যাহত রয়েছে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিও। এজন্য অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাল আমদানি ও বাজারজাত করার সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
বৈরিতা থাকলেও অর্থনৈতিক বাস্তবতা অস্বীকারের সুযোগ কোনো দেশেরই নেই বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘এটাই হলো বাস্তবতা। যেমন চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সংঘাত হয়েছে দোকলাম ভ্যালিতে। রীতিমতো সরাসরি সংঘাত হয়েছে। কিন্তু দুই বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিকে তাকালে দেখা যায় তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ব্যাপক। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের উদাহরণও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবেই হুমকি হিসেবে চীন ও রাশিয়াকে মোকাবেলার কথা বলা আছে। তার পরও অর্থনৈতিক সম্পর্কসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু বিষয় তারা রাজনৈতিকীকরণ করে না। অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্বায়নের বর্তমান যুগে বা আন্তঃনির্ভরশীলতার যুগে অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকারের সুযোগ নেই। আমি মনে করি জনমানসে এক ধরনের ধারণা থাকবেই। কিন্তু যারা নীতি প্রণয়নকারী, যারা দেশ পরিচালনা করবেন; অনেক বিষয়েই তাদের খুব বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে জায়গায় পরিপক্বতা প্রয়োজন হয়। সেখানে অর্থনৈতিক যুক্তির বিষয় থাকে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা এখন ভারত থেকে চাল নিয়ে আসছি। কারণ ভারত আমাদের অনেক কাছে। সেখান থেকে পণ্য পরিবহনের সুবিধা আছে। সেদিক থেকে আমাদের সরকার পরিপক্বতার পরিচয় দিচ্ছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের পানিসহ সীমান্ত ইস্যু রয়েছে। নতুন ইস্যু হলো অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী এখন ভারতে অবস্থান করছেন। এখানে আরেকটি বিষয় রয়েছে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য নির্ভরতা কমানোর জন্য যে বিকল্প বাজারগুলো আমরা এখনো এক্সপ্লোর করতে পারিনি। এটা এত সহজও নয়। কারণ যে পণ্যগুলো আমরা ভারত থেকে আমদানি করি, সেগুলোর বিকল্প উৎস পাওয়াটা আমার কাছে খুব কঠিন বলে মনে হয়। এ কারণেই হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার একটা এনগেজমেন্টের পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ন্যায্যতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে সমতা আনার চেষ্টা করছেন তারা। অন্যদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্কের জায়গাটিতে পারস্পরিক নির্ভরতা বা সুবিধার বিষয়টিকেও আমরা রক্ষা করছি। এটা বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন বলেই আমি মনে করি।’
প্রতিবেশী দেশটি থেকে বাংলাদেশ এখন বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেলও আমদানি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের মধ্যেই ভারত থেকে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছিল। এ আমদানির ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গত জানুয়ারির মাঝামাঝি ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টন ডিজেল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এতে খরচ ধরা হয় ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এ ডিজেল আমদানি করার কথা।
তবে ভিসা জটিলতার কারণে ভারতীয়দের সঙ্গে ব্যবসা করা এখন কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ইন্ডিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে কোনো অসুবিধা নেই। আমরা এ বাণিজ্যকে আরো ভালো করতে পারি। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হলো ভিসা। আমাদের অনেক ব্যবসায়ীর এখন ভিসা হচ্ছে না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। সারা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বন্দরগুলোকে ঘিরে যে আমদানিকারকরা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, পণ্য কেনাবেচা করছেন, তাদের অধিকাংশই ভিসা পাচ্ছেন না। ফলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
আবদুল ওয়াহেদ আরো বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী, আমরা রাজনীতিতে জড়াতে রাজি না। পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের তেমন কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ভিসার জন্য ব্যবসার কাজগুলো ভালোভাবে সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। যে যাই বলুক, বাংলাদেশের সীমান্তের সিংহভাগ ভারতের সঙ্গে। বিশেষ করে আসাম-মেঘালয়, পশ্চিম বাংলার মতো অঞ্চলগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ভাষা-সংস্কৃতির অনেক মিল। দুই দেশের যখন যা প্রয়োজন হয়, সেসব বিবেচনায় আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক রেখেছি। ব্যবসায়ীরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে দুই দেশেরই অর্থনীতিকে সহায়তা করতে চায়।’
বর্তমানে জাতীয় গ্রিডে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের অবদান ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টায় জাতীয় গ্রিডে ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল ১ হাজার ৭৫৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে সরবরাহ ছিল ৭৬০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে আদানির কাছ থেকে নেয়া বিদ্যুতের খরচ পড়ছে তুলনামূলক বেশি। ডলার সংকটের কারণে বকেয়া বিল জমে যাওয়ায় গত বছরের ৩১ অক্টোবর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয় আদানি। এতে বাংলাদেশে গ্রুপটির গড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরবরাহ অর্ধেকে নেমে আসে। শীতে চাহিদা কম থাকায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও একটি ইউনিট থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বলা হয়েছিল আদানিকে। এ অবস্থায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে আদানি গ্রুপ। তবে আসন্ন গ্রীষ্মকালের চাহিদা পূরণের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবারো পুরো সক্ষমতা (১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট) অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আদানিকে অনুরোধ করা হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রয়োজন রাজনৈতিক বিবেচনাকে ছাপিয়ে যাওয়ার কারণেই এখন বাংলাদেশে ভারত থেকে পণ্য আমদানি বাড়ছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক কূটনীতির পর্যবেক্ষকরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ভারত থেকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পণ্য রফতানি বেড়েছে। বাংলাদেশের রফতানি খাত মূলত আমদানি নির্ভর। চীন ও ভারত থেকে কাঁচামাল না এলে বাংলাদেশ রফতানি করবে কী করে? বিষয়গুলো বাইরে থেকে সাদা চোখে দেখা যায় না। দুই দেশেরই পারস্পরিক সম্পর্কে একে অন্যের প্রতি মর্যাদাবোধের প্রকাশ থাকা উচিত। অর্থনৈতিক বিষয়গুলোয় আমরা গভীরভাবে সংযুক্ত। এর সঙ্গে কখনো কখনো রাজনীতি একই পথে না-ও এগোতে পারে, যেটা এখন দেখা যাচ্ছে। বাণিজ্যের অর্থই হলো আমাদের প্রয়োজন আছে বলেই ওই দেশ থেকে পণ্য আসে। অর্থাৎ বাণিজ্য হচ্ছে চাহিদা ও সরবরাহনির্ভর। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের এনার্জি তৈরি হয়েছে। মানুষ এখন অনেক বেশি অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে এখন অর্থনীতি ওপর দিকে আসার চেষ্টা করছে। জুন-জুলাই অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা গিয়েছিল। এখন তা আবার পিকআপ করছে। বাস্তবতা হলো আমরা একে অন্যের প্রতি অনেক বেশি গভীরভাবে নির্ভর। না চাইলেও এটা ঘটবে। কারণ চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে এটা চলে। ফলে বাণিজ্যে যা হওয়ার ছিল, সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।’
তবে বৈরিতা দীর্ঘস্থায়ী হলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে কোনো না কোনো সময় এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি। তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ের পর নানা সংকট দেখা গিয়েছিল। দেখা গেল আজকে ডিমের সংকট, আগামীকাল অন্য সংকট। এ সংকট মোকাবেলা করার অপশন তখন খোলা ছিল না। ভারত ছাড়া কোনো বিকল্প উৎস ছিল না। এখন বাজার অন্যান্য জায়গায় যাচ্ছে। যেমন পেঁয়াজ এখন অন্যান্য উৎস থেকেও আসতে শুরু করেছে। বিগত ১৬-১৭ বছরে এসব পণ্যের জন্য আমরা ভারতনির্ভর ছিলাম। যেকোনো পণ্যের ঘাটতি হলে সেটা ভারত থেকে নিয়ে আসা অসম্ভব কিছু ছিল না, অনেক সহজ ছিল। কাজেই বিভিন্ন মহলে যতই ভারতবিরোধী মনোভাব দেখা যাক, সেটার প্রতিফলন বাণিজ্যে দেখা যায় না। তবে এ মনোভাব দীর্ঘস্থায়ী হলে কালক্রমে দেখা যাবে যে পণ্য আমদানি-রফতানিতেও এর একটা প্রভাব পড়বে। এখন যেমন পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য দেখা যাচ্ছে। দেশটি থেকে জাহাজ আসছে পণ্য নিয়ে। এ ধরনের বিকল্প উৎসগুলো চালু হতে থাকবে এবং সেটা হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটা যদি বন্ধুত্বমূলক না হয়, তাহলে সেটা বাণিজ্যের ওপর ধীরে ধীরে হলেও একটা প্রভাব ফেলবে। এ কারণে আমাদের বিকল্প খুঁজতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘বাণিজ্যে বিশেষ করে পণ্য আমদানির উৎসে বৈচিত্র্য আনতে সরকারের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখনো পুরোপুরি না হলেও সেসব কার্যক্রমের প্রতিফলন কিছুটা দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।’ ●
অকা/প্র/ই/সকাল, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 3 months আগে