অর্থকাগজ প্রতিবেদন ●
বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক চাকরির বাজার টানা এক বছরের স্থবিরতা কাটিয়ে ফের প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। সাম্প্রতিক দুই মাসে চাকরির বিজ্ঞাপন বাড়তে শুরু করেছে, যা শ্রমবাজারে একটি ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন—এই উত্থান এখনও দেশের বিপুল কর্মসংস্থানের চাহিদা মেটানোর মতো নয়। একই সঙ্গে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের একচেটিয়া আধিপত্য দীর্ঘমেয়াদে শ্রমবাজারে বৈচিত্র্য ও স্থায়িত্বের পথে বড় বাধা হয়ে উঠছে।
চাকরির বিজ্ঞাপনে দৃশ্যমান বৃদ্ধি
দেশের সর্ববৃহৎ অনলাইন নিয়োগ প্ল্যাটফর্ম বিডিজবস জানিয়েছে, ২০২4 সালের জুলাই মাসে প্রায় ৮ হাজার চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে, যা আগস্টে বেড়ে ৯ হাজার ছাড়াতে পারে। এর আগে গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত মাসে গড়ে মাত্র ৪-৫ হাজার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হচ্ছিল। অর্থাৎ সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞাপন দ্বিগুণের কাছাকাছি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী এ কে এম ফাহিম মাশরুর জানান, এ উত্থান মূলত এফএমসিজি (নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য) এবং তৈরি পোশাক খাত দ্বারা চালিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রতিষ্ঠান বিডিজবসের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ করছে। তবে উন্নয়ন খাতে চাকরি কমেছে, কারণ ইউএসএইডসহ আন্তর্জাতিক দাতাদের অর্থায়ন কমেছে।
শিল্পখাতে নিয়োগের চিত্র
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পাঁচের একটি ডিবিএল গ্রুপ জানিয়েছে, তারা নতুন বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বার জানান, মার্চে অধিগ্রহণ করা নতুন কারখানায় ৪২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং আধুনিকায়নে আরও ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এসব বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে।
অন্যদিকে ইউনিলিভার বাংলাদেশ–এর চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার জানিয়েছেন, টানা দুই বছরের মন্দার পর প্রতিষ্ঠানটি স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিতে ফিরছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি, তবে বাজারে পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত স্পষ্ট।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলে শামীম এহসান মনে করেন, নিয়োগ বিজ্ঞাপনের সাম্প্রতিক উত্থান মূলত গত এক বছরের নিয়োগ-স্থবিরতার ঘাটতি পূরণের প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, “প্রকৃতপক্ষে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বদলে এখনকার নিয়োগ কেবল ফাঁক পূরণ করছে।”
এই প্রেক্ষাপটে তিনি মনে করেন, প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ নতুন কর্মপ্রত্যাশী শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদেশে পাড়ি জমান। বাকি প্রায় ১৫ লাখ কর্মীকে দেশীয় চাকরির ওপর নির্ভর করতে হয়, যেখানে পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।
শিক্ষিত বেকারত্বের সংকট
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক জরিপ অনুযায়ী—
-
দেশের শ্রমশক্তির মাত্র এক-পঞ্চমাংশ আনুষ্ঠানিক চাকরিতে রয়েছে।
-
প্রায় ৭০ শতাংশ শ্রমশক্তি এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত।
-
শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্ব উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ২০২৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা ৯ লাখ ছাড়িয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি।
-
উচ্চমাধ্যমিকোত্তর শিক্ষিত বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে।
বিশেষত নারীরা দ্বিগুণ বঞ্চনার শিকার—তাদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার কম, আর বেকারত্বের হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
বড় করপোরেশনের আধিপত্যের ঝুঁকি
চাকরির বাজারে বড় করপোরেশনের একচেটিয়া অবস্থানও নতুন সংকট তৈরি করছে। এ প্রসঙ্গে ফজলে শামীম এহসান বলেন, “একটি বড় কারখানা সম্প্রসারিত হলে অনেক ছোট কারখানার উৎপাদন শোষণ করে নেয়। এতে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়, আর তাদের দক্ষ কর্মকর্তারা বেকার হয়ে পড়েন।”
উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, একটি কারখানা যদি ৩০টি নতুন উৎপাদন লাইন যোগ করে, তবে তা প্রায় ছয়টি ছোট কারখানার উৎপাদন গিলে ফেলে। কিন্তু সেই সম্প্রসারিত কারখানায় আগের মতো একাধিক ম্যানেজারের প্রয়োজন হয় না—ফলে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়।
এ প্রবণতা শুধু পোশাক নয়, অন্যান্য শিল্পেও ঘটছে। মুড়ি, চানাচুর বা চালের মতো ঐতিহ্যবাহী ছোট ব্যবসাগুলো বড় করপোরেশনের দখলে যাচ্ছে, ফলে লাখো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
নীতি সুপারিশ
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, সরকারকে ছোট ব্যবসাগুলোকে রক্ষার জন্য বিশেষ নীতি প্রণয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, “অনেক দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও এমন নীতি গ্রহণ না করলে বড় করপোরেশনের সম্প্রসারণের ফলে লাখো মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “শ্রমবাজারকে টেকসই ও বহুমুখী করার জন্য ছোট ব্যবসা ও নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা এখন সময়ের দাবি।” ●
অকা/প্র/ই/সকাল/২৮ আগস্ট, ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
সর্বশেষ হালনাগাদ 2 weeks আগে